ঘড়ি: সময়ের হিসাবে মুসলিম সভ্যতার অবদান


1001 inventions অবলম্বনে, আবরার শেখ
Published: 2021-11-04 19:57:13 BdST | Updated: 2024-05-14 05:58:42 BdST

সময়ের হিসাব রাখার জন্য ঘড়ির ব্যবহার ছিলো বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রাচীনকালে সময়ের পরিমাপের জন্য যে বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি ও যন্ত্র ব্যবহার করা হত, মুসলিম বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও কারিগররা তার বিভিন্ন উন্নয়ন সাধন করেন। এছাড়া তারা সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ নির্মাণের মধ্য দিয়ে আধুনিককালে প্রচলিত ঘড়ি তৈরির দিকে অগ্রসর হন। এই প্রসঙ্গে মুসলিম প্রকৌশলীদের তৈরি করা বিখ্যাত কিছু ঘড়ি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

 

১. আল জাজারীর দূর্গ ঘড়ি/দ্বাদশ শতাব্দী

মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আল-জাজারী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-জামিউল বায়ান আল-ইলম ওয়াল আমাল আন-নাফি ফি সিনাত আল-হায়াল’ (যান্ত্রিক শিল্পকলার তত্ত্ব ও অনুশীলনের সারসংক্ষেপ) নামক গ্রন্থে তার তৈরিকৃত বিখ্যাত দূর্গঘড়ির কথা বর্ণনা করেন। পানিপ্রবাহের প্রযুক্তিতে চালিত এই ঘড়িটি সম্পর্কে তার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে্ই বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

দিনের বেলা ঘড়িটির উপরের চাকতির ডান দিক হতে সূর্য উঠতে দেখা যেত। দিনের শেষে সূর্য ডুবে গেলে অর্ধচন্দ্রাকৃতির চাঁদ চাকতির বাম হতে ডানে স্থানান্তরিত হত। প্রতি ঘন্টা পার হলে ডিস্কের নিচে অবস্থিত দুইটি দরজার সারি হতে উপরের সারির একটি দরজা খুলে একটি পুতুল বের হত এবং তার নিচের দরজাটি উল্টে গিয়ে ভিন্ন একটি রং প্রদর্শন করতো। এর পরপরই দুইপাশের দুইটি বাজ পাখি তাদের খোপ ছেড়ে সামনে বেরিয়ে আসতো এবং তাদের পাখা ছড়িয়ে দিতো। এসময় তাদের ঠোঁট হতে একটি করে বল বেরিয়ে তাদের সামনে রাখে পাত্রে পড়তো। এসময় ঘড়ির মধ্য হতে হালকা ঝনঝনির আওয়াজ শোনা যেতো। এরপরই বাজপাখিগুলো আবার ডানা গুটিয়ে তাদের খোপে ঢুকে পরতো।

 

২. উমাইয়া মসজিদের ঘড়ি/ত্রয়োদশ শতাব্দী

মূলত ৮০০ বছর পূর্বে দামিশকের উমাইয়া মসজিদে নির্মিত এই ঘড়িটি বর্তমানে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। মূল  ঘড়িটি দামিশকের মধ্যযুগের বিখ্যাত প্রকৌশলী রিদওয়ান আল-সাতী তৈরী করেন। এই দৃষ্টিনন্দন যান্ত্রিক ঘড়িটিতে সংখ্যার সাহায্যে সময় নির্দেশ করা হত। ঘড়িটির দুইপাশে দুইটি বাজপাখি ছিলো, যেগুলো একঘন্টা পর পর তাদের সামনে রাখা পাত্রে কপারের বল রাখতো। রাতে ঘড়িটিতে সময় নির্দেশের জন্য আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিলো। একটি চাকতির ঘূর্ণনের ফলে এই আলো ঠিক সূর্যাস্তের পর জ্বলে উঠতো্।

ইবনে জুবায়েরের ভাষ্যমতে, ঘড়িটি দুইটি অংশে বিভক্ত ছিলো। নিচের অংশে ঘড়িটির ইঞ্জিন অবস্থিত ছিলো। পানিপ্রবাহের প্রযুক্তিতে এই ইঞ্জিনটি পরিচালিত হত।

 

৩. তাকী উদ্দিনের ঘড়ি/ ষোড়শ শতাব্দী

ওসমানীয় যুগের মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী তাকী উদ্দীন ইবনে মারূফ তার বই ‘আল-কাওকাব আল-দুররিয়া ফি ওয়াদ আল-বানকামাত আল-দাওরিয়া’ (যান্ত্রিক ঘড়ি নির্মানের উজ্জ্বল নক্ষত্র) নামক গ্রন্থে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রচলিত সময়ের হিসাব রাখার জন্য চারটি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হল, বহনযোগ্য ঘড়ি (watch), বাড়িতে সংরক্ষণ উপযোগী ঘড়ি (domestic clock), জ্যোতিশাস্ত্রীয় ঘড়ি (astronomical clock) প্রাচীর ঘড়ি (tower clock)।  

ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষনায় নির্ভুল হিসাবের ঘড়ি ছিলোনা। তাকী উদ্দীন নির্ভুল হিসাবের ঘড়ি তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করেন। তার পূর্বে টলেমি এধরনের ঘড়ি তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন।

সূক্ষ্ম গাণিতীক হিসাবনিকাশের পর তিনি তার ঘড়িতে ঘন্টা, ডিগ্রি ও মিনিট এই তিনটি ডায়াল নির্ধারন করেন। তাকী উদ্দীন তার ঘড়িটি বিভিন্ন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরি করেন। তার ঘড়িতে অ্যালার্মের ব্যবস্থা ছিলো। এছাড়া ঘড়িটিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিলো। বর্তমানের আধুনিক ঘড়িগুলোতে তাকী উদ্দীনের তৈরি করা ঘড়ির অনেকগুলো অংশই বিদ্যমান রয়েছে।

 

৪. আল-মুরাদীর ঘড়ি/ একাদশ শতাব্দী

আন্দালুসিয় মুসলিম বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আল-মুরাদীর রচিত ‘বুক অব সিক্রেট’এ প্রথম দিকের পানি প্রবাহের প্রযুক্তিতে চালিত বিভিন্ন ঘড়ির আরবী বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইয়ে ঘড়ি এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রের বিবরন রয়েছে। এই বইয়ে ১৯টি ঘড়ির প্রযুক্তির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে যেগুলো পানি প্রবাহের প্রযুক্তিতে চলতো।

 

৫. আল-কারাউন মসজিদের ঘড়ি/ ত্রয়োদশ শতাব্দী

বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আলকারউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের মিনারে অবস্থিত পানি প্রবাহের প্রযুক্তিতে চালিত একটি ঘড়ি বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি পুরাতন ঐতিহাসিক নিদর্শন। ১২৮৬/৮৭ ইবনে হাব্বাক আল-তিলিমসানী এটি তৈরি করেন।

ঘড়িটির সময় ও সংরক্ষণের জন্য একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন যিনি ঘড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং আজানের  জন্য মুয়াজ্জিনকে সঠিক সময় অবহিত করতেন।

মরক্কোর ফেজে অবস্থিত আল-কারউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে ঘড়িটি এখনো্ সংরক্ষিত আছে।

 

৬. ইবনে হাইসামের ঘড়ি/ দশম শতাব্দী

আলোর গতিপথ ও ক্যামেরার কৌশল আবিস্কারের জন্য বিখ্যাত আল হাসান ইবনে হাইসাম তার তৈরিকৃত ঘড়ির জন্যও বিখ্যাত। তার রচিত গ্রন্থে ঘড়িটির প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তার ঘড়িতে ঘন্টা ও মিনিট প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিলো। এই ঘড়িটিও পানি প্রবাহের প্রযুক্তিতে চলতো।

 

৭. আল জাজারীর হাতী ঘড়ি/ ত্রয়োদশ শতাব্দী

মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আল জাজারীর বিখ্যাত হাতী ঘড়ি মুসলিম সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত ও বিখ্যাত ঘড়ি। এই ঘড়িটিও পানি প্রবাহের প্রযুক্তিতে চালিত। গ্রীক পানি প্রবাহ প্রযুক্তি, ভারতীয় হাতি, মিশরীয় ফনিক্স, আরব পুতুল ও চীনা ড্রাগনের সমন্বয়ে ঘড়িটি বিশ্বের বিভিন্ন বৈচিত্র্যকে একত্রে ধারণ করেছে।

ঘড়িটির চূড়ায় অবস্থিত পুতুলটি ঘন্টার হিসাব ও হাতীর হাওদায় বসা পুতুলটি মিনিটের হিসাব রাখতো। প্রতি আধঘন্টা পরপর এতে সংকেত প্রদানের ব্যবস্থা ছিলো।

 উৎস     

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিজ্ঞান বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পর...

বিজ্ঞান | 2018-07-01 03:21:51

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

বিজ্ঞান | 2018-07-14 00:00:36

শাইখ আল-রাইস শরীফ আল-মুলক আবু আলী আল-হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন আল-হাসান...

বিজ্ঞান | 2018-10-11 23:45:28

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ ট...

বিজ্ঞান | 2018-03-30 10:24:15

আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অব...

বিজ্ঞান | 2018-07-27 06:06:44

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও...

বিজ্ঞান | 2017-11-12 21:00:39

 "কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্...

বিজ্ঞান | 2021-09-17 14:11:09

ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোব...

বিজ্ঞান | 2017-10-28 11:12:25