মুসলমানদের যে ৫ আবিষ্কার বিশ্বে পরিবর্তন এনে দিয়েছে


ফিরাস আল খাত্তাব; অনুবাদঃ মুরশেদ মুহাম্মদ প্রিন্স
Published: 2022-01-06 21:41:34 BdST | Updated: 2024-05-14 08:30:58 BdST

কফি

ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, ১৪ শতকের দিকে দক্ষিণ আরব উপদ্বীপ ইয়েমেনের তথা মুসলমানদের কাছে কফি একটি জনপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠে। মজার বিষয় হচ্ছে এত বড় আবিষ্কারটি করেছিলেন একজন রাখাল (কেউ বলেছেন তিনি ইয়েমেনের আবার কেও বলেছেন ইথিওপিয়ান) লক্ষ্য করে দেখলো যে তার ছাগলগুলো একটি  বিশেষ গাছ থেকে শিমের বিচির মত কিছু খেয়ে খুব চাঙ্গা ও চঞ্চল হয়ে উঠে। তা দেখেই সেটি নিজের উপর প্রয়োগ করার সাহস করেছিল, এবং সে মনে করেছিল যে এগুলো ব্যবহার করে তার শক্তি বৃদ্ধি পাবে। সময়ের সাথে সাথে, এই বীজগুলো ভেজে খাওয়ার অভ্যাস আস্তে আস্তে পানিতে মিশিয়ে একধরনের পানীয় প্রস্তুত করে পান করতে করতেই আজকের বিখ্যাত কফিতে রুপান্তরিত হয়েছে।

 

মেষপালকের গল্পটি সত্য যদি নাও হয় তবুও ১৫ শতকে ইয়েমেনের উচ্চভূমি সহ উসমানী সাম্রাজ্যের অপরাপর  জায়গাগুলোতেও কফি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শহর যেমন কায়রো, ইস্তাম্বুল, দামেস্ক, বাগদাদ সহ অপরাপর শহরগুলোতে কফি একটি জনপ্রিয় পানীয় হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। আর এ মুসলিম বিশ্ব থেকেই উচ্চ মানসম্মত কফি ইতালির ভেনিস হয়ে ইউরোপে রপ্তানি করা হত।

 

যদিও ক্যাথলিক চার্চ কতৃপক্ষ কফিকে প্রথম দিকে মুসলিম পানীয় হিসেবে নিন্দা করত কিন্তু খুব দ্রুতই কফি ইউরোপিয়ান সমাজের অংশে রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৬ শতকের কফি হাউসগুলো অধিকাংশ সময়েই দার্শনিকদের আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছিল যেখানে বসেই তারা মানবাধিকার, সরকারের রূপরেখা ও গণতন্ত্রের মত দর্শনগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। কফি খেতে খেতে আলোচিত হওয়া এই বিষয়গুলোই পরবর্তীতে আধুনিক বিশ্বের জন্য এক বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।  

 

সেই ইয়েমেন/ইথিওপিয়ান রাখালের হাত ধরে পথ চলে ইউরোপের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারা কফি আজ প্রতিদিন এক বিলিয়ন কাপেরও বেশী খাওয়া হচ্ছে। তাই বলাই যায় মানব ইতিহাসে মুসলিমদের এ ছিল এক অনবদ্য আবিষ্কার।

 

বীজগণিত

যদিও মাধ্যমিক শ্রেণির অনেক ছাত্র গণিত ভাল করে বুঝতে না পারায় হয়তো গণিতের বিশেষ শাখা বীজগণিতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনা, যা ইসলামের স্বর্ণযুগের অন্যতম বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আর খাওয়ারিজমির (৭৮০-৮৫০) এক মহান আবিষ্কার।   

তার রচিত “আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব আল যাবর ওয়াল মুকাবিলা” বইটিতে বীজগণিতের প্রাথমিক সকল উপাত্ত ও সুত্রের সমাহার ঘটেছিল। এই বইয়ের নাম আল যাবর অর্থাৎ পরিপূরক শব্দটিই পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় আলজেবরা নামে পরিণত হয়েছে। বইটিতে খাওয়ারিজমি দেখিয়েছেন কিভাবে বীজগাণিতিক  সমস্যার সমাধান করা যায় এবং সেই সাথে অজানা অনেক গাণিতিক সমস্যার সমাধান তিনি বইটিতে সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন যেগুলো সমাধানের মাধ্যমে তৎকালীন কঠিন বাস্তব সমস্যা যাকাত ও উত্তরাধিকার বন্টনগুলো অনেক সহজ হয়েছিল। তার এ আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামী অনুশাসনগুলো যেন আরও সুন্দরভাবে পালিত হতে পারে। যে সময়ে ক্যালকুলেটর কিংবা কম্পিউটার ছিলনা তখনো শুধু তার ফর্মূলা ব্যবহার করেই এমন সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা যেত।

 

হাজার শতক কিংবা ১১ শতকের দিকে তার বইগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়েছিল যার নাম ছিল আলগোরিদমি  (আলগরিদম তার নাম ও কর্মকে স্মরণে রাখতেই বইয়ের এ নামকরণ)। যদি তিনি এ বই আবিষ্কার না করতেন তবে আজকের এ উন্নত বিশ্ব তার জটিল গাণিতিক সমস্যা যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে কিংবা অন্যক্ষেত্রে সমাধান করা সম্ভব হত না। তার এ বই মৃত্যুর পরও ইউরোপে শত শত বছর গণিতের পাঠ্যবই হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর প্রবর্তন

বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উঠলেও দেখা যায় এ আবিষ্কারটিও মুসলিমদের দ্বারাই হয়েছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগে  মসজিদ নামাজের পাশাপাশি পাঠশালা হিসেবেও ব্যবহৃত হত। ইমাম নামায পড়ানোর পাশাপাশি মানুষকে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, কোর’আন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি শিক্ষা দিতেন। আস্তে আস্তে মুসলিম সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পেলে প্রতিষ্ঠিত পাঠশালার প্রয়োজন দেখা দেয় যেগুলো পরবর্তীতে মাদরাসা নামে পরিচিতি লাভ করে।   

Image result for Universities muslim invention

প্রথম আনুষ্ঠানিক মাদ্রাসা ছিল আল-কারাউইন, এটি ৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেস নামক স্থানে ফাতিমা আল-ফাইহরি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠান ছিল উত্তর আফ্রিকার নেতৃস্থানীয় পণ্ডিতদের পাশাপাশি সেই অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আল-কারাউইনে, শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর শিক্ষকদের কাছ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ থেকে শুরু করে ধর্মীয় বিজ্ঞান পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে, শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের যোগ্য বলে মনে করলে, তাদেরকে ইজাজা হিসাবে পরিচিত একটি সার্টিফিকেট প্রদান করতেন, এর অর্থ ছিল সেই শিক্ষার্থী এই বিষয়টি বোঝে এবং এখন সেও শিক্ষক হওয়ার যোগ্য।

 

প্রথমবারের মত ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং এক হাজার সালে সেলজুক সহ মধ্যপ্রাচ্যে জুড়ে কয়েক ডজন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইউরোপের সমাপ্তি (ডিগ্রি) সার্টিফিকেট প্রদান করে এমন প্রতিষ্ঠান লাভ করে ইউরোপিয়ানরা মুসলিম স্পেনে শিক্ষা গ্রহণের পর। এগারো শতক এবং বারো শতকে যথাক্রমে ইতালির বুলুঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয় এবং  ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়ে মুসলিমদের রেখে যাওয়া সেই ঐতিহ্য এখনো বজায় রেখেছে। মুসলিমদের মতই তারাও প্রতিটি বিষয়ে আলাদাভাবে পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ করেছে।

 

সেনাবাহিনীর মার্চিং ব্যান্ড

পশ্চিমা বিশ্বের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মার্চিং ব্যান্ডের সাথে ভালোই পরিচিত। শত শত বাদকদের সমন্বয়ে  বাদক দল গঠন করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা কিংবা বড় কোন অনুষ্ঠানে দর্শকদের আনন্দ এবং অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে বাদক দল মাঠ প্রদক্ষিণ করেন। ইউরোপের গানপাউডার যুগে সৈনিকদের উৎসাহ দিতে যে ব্যান্ড বাজানো হত তার উপর ভিত্তি করেই এই বাদকদল গঠন করা হয়। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সে বাদকদলও সর্বপ্রথম গঠন করা হয়েছিল ১৩ শতকের যুদ্ধের ময়দানের অন্যতম শক্তিশালী উসমানী সেনাবাহিনীর মেহথের ব্যান্ডের আদলে।   

Image result for Military Marching Bands muslim invention

উসমানীদের বিশেষ জেনিসারি বাহিনীর জন্যই এই মেহথের ব্যান্ডের সুচনা করা হয়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মনে ভয় জাগাতে ও মিত্রদের উৎসাহ দিতে বিশাল ড্রামের পাশাপাশি চেইম্বল বাজানো হত। এই মেহথের মিউজিক এতই শক্তিশালী ছিল যে অনেক মাইল দূর থেকেও তার আওয়াজ শুনা যেতো। ১৪-১৬ শতকে উসমানীয়রা যখন বলকান অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেছেন তখন এই মেহথের মিউজিক শত্রুর মনে এমনকি সকল ইউরোপিয়ান ঐক্যজোটের কাছেও ছিল এক আতঙ্কের নাম।  

 

এমনকি ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী যে মিউজিক ব্যান্ড ব্যবহার করত তাও উসমানিদের অবদান। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনায় পরাজয়ের পর উসমানিয়রা অনেক ব্যান্ড সরঞ্জাম ফেলে আসে। অষ্ট্রিয়া সেগুলো সংগ্রহ করে তার ব্যবহার শিখে নিজের সেনাবাহিনীর জন্য ব্যান্ড গঠন করে। উসমানীদের হাত ধরে চলা এই ব্যান্ড পরবর্তিতে ইউরোপ সেনাবাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হয়।    

 

ক্যামেরা

ফটোগ্রাফি ছাড়া বর্তমান বিশ্বকে কল্পনা করা কঠিন। ইন্সটাগ্রাম এবং ক্যাননের মত বিলিয়ন ডলার কোম্পানিগুলোও একটি দৃশ্য থেকে আলোক চিত্র ধারণ, তা থেকে একটি ইমেজ তৈরি এবং সেই ইমেজ পুনরুৎপাদনের ধারণার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু এগুলো বর্তমানে সম্ভব হতো না যদি এগারো শতাব্দীর মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে আল-হায়সাম অপটিক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রকে বিকশিত না করতেন। শুধু তাইনা ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে তার বর্ণনাও তিনি আলোচনা করে গিয়েছেন।

Related image

হাজার শতাব্দীতে মিশরের রাজধানী কায়রোতে সর্বকালের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী কাজ করতেন। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তাকে আরও কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সে সমন্ধে এই মহান বিজ্ঞানী নিরলস কাজ করে গেছেন, এবং মৌলিক বিজ্ঞানগুলো কিভাবে কাজ করছে সে সমন্ধেও তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েগেছেন। ফাতিমী শাসক আল হাকিমের সময়কালে গৃহবন্ধী থাকার সময় তিনি আলোক বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তার গবেষণালব্ধ  বিজ্ঞান আধুনিক পিনহোল ক্যামেরা তৈরিতে কাজে লেগেছে।

 

ইবনে আল-হায়সাম হলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যখন কোন আলো নিরোধক বক্সে ক্ষুদ্র একটি ছিদ্রপথে বাইরে থেকে আলো ভিতরে প্রবেশ করে তখন তা সেই বক্সের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই পিনহোল যত ক্ষুদ্র হবে বাইরে থেকে আসা আলোর প্রতিফলন ততই সুন্দর হবে যা তাকে একটি আদর্শ ক্যামেরা তৈরি করতে এবং ছবি তুলতে সক্ষমতা দান করেছিল।

 

ইবনে হাইসামের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক ক্যামেরার সংস্ককরণগুলোকে আরও উন্নত করেছে। আলো কিভাবে ক্ষুদ্র ছিদ্রপথে ভ্রমণ করে কাজ করে যদি তিনি এ আবিষ্কার না করতেন তবে আধুনিক যুগের ক্যামেরা আমাদের কাছে আসত না!   

উৎস

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিজ্ঞান বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পর...

বিজ্ঞান | 2018-07-01 03:21:51

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

বিজ্ঞান | 2018-07-14 00:00:36

শাইখ আল-রাইস শরীফ আল-মুলক আবু আলী আল-হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন আল-হাসান...

বিজ্ঞান | 2018-10-11 23:45:28

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ ট...

বিজ্ঞান | 2018-03-30 10:24:15

আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অব...

বিজ্ঞান | 2018-07-27 06:06:44

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও...

বিজ্ঞান | 2017-11-12 21:00:39

 "কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্...

বিজ্ঞান | 2021-09-17 14:11:09

ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোব...

বিজ্ঞান | 2017-10-28 11:12:25