আল-কোরআন ও মহাবিশ্ব


মোহাম্মদ আশফাক হুসাইন
Published: 2018-07-27 06:06:44 BdST | Updated: 2024-05-14 20:34:41 BdST

Photo Credit: banglagazette

আল্লাহ তা’আলা বলেন :

অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ। (আশ-শু‘আরা ২৬: ১৯২)

ইয়াসিন। বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ। (ইয়াসিন ৩৬:১-২)

 

সপ্তম শতাব্দিতে কোর’আন নাযিল হয়। ঐ সময় সামাজিক অবস্থা থেকে শুরু করে  বৈজ্ঞানিক সব কিছু ছিল নাজুক অবস্থায়। মানুষ তখন প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে কুসংস্কার ও প্রাচীন উপকথায় বিশ্বাসী ছিল।  কুসংস্কারে আচ্ছন্ন যুগেই নাযিল হয়েছিল আল-কোর’আন। যাতে এক হাজারেরও বেশী আয়াতে বিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছে। অথচ সেই কোর’আনে ১টি আয়াতও আজ পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত হয় নি আর হবেও না।  

 

আমরা সকলে জানি যে, বিজ্ঞান সিদ্বান্ত পরিবর্তন করতে পারে। খুঁজলে এই রকম দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যাবে। আমরা এখানে শুধু মহাবিশ্ব সর্ম্পকিত বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য নিয়ে আলোচনা করবো, কল্পনা বা ধারণার (Theory) উপর নির্ভরশীল কোনো তত্ত্ব নয়, যা প্রমাণিত হয়নি। তবে আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করবো  না। কয়েকটি বিষয়ে সাধারণ প্রমাণ উপস্থাপন করে আলোচনার ইতি টানবো, যাতে সকলের বুঝতে সহজ হয় আর আলোচনাও দীর্ঘ না হয়।

 

১. বিগ ব্যাং থিওরি ও বিশ্ব সৃষ্টি :

আমরা জানি যে, বিগ ব্যাং থিওরি অনুযায়ী মহাবিশ্ব ছিল প্রথমে একটি বিশাল নীহারিকা। পরে ২য় পর্যায়ে তাতে এক বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে ছায়া পথ তৈরী হয়। এগুলো পরে তারকা, গ্রহ, সূর্য ও চন্দ্র ইত্যাদিতে রুপান্তরিত হয়।

পবিত্র কোর’আন মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতে বলেছে,

অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?  (আল-আম্বিয়া ২১: ৩০)

আবার বিগ ব্যাং থিওরীর একটা অনুসিদ্ধান্ত হল অনবরত দূরে সরে যাওয়া গ্রহ নক্ষত্রগুলো একসময় আবার কাছাকাছি আসা শুরু করবে কেন্দ্রবিমুখী বল শুন্য হয়ে যাওয়ার ফলে এবং সময়ের ব্যাবধানে সব গ্রহ নক্ষত্র আবার একত্রে মিলিত হয়ে একটা পিন্ডে পরিণত হবে।  

অথচ দেড় হাজার বছর আগের আল কোর’আনে আল্লাহ তা'আলা বলেন,

সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব যেমনভাবে (লিখিত) কাগজ-দলীল গুটিয়ে রাখা হয়। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে আবার সৃষ্টি করব। ওয়া‘দা আমি করেছি, তা আমি পূর্ণ করবই।  (আল-আম্বিয়া ২১: ১০৪)

 

২. মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল :

মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল এটা কিছুদিন আগেই প্রমাণিত হয়েছে। প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্টিফেন হকিং তার A Brief History of time বইতে লিখেছেন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কিত আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর মহান বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। ১৯২৫ সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবেল পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণের সাহায্যে বলেছেন, প্রতিটি ছায়াপথ অন্য ছায়াপথ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এর অপর অর্থ হল, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এখন বৈজ্ঞানিক সত্য। কোর’আন মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে একই কথা বলেছে। আল্লাহ বলেন,  

আমি নিজ হাত দ্বারা আসমান সৃষ্টি করেছি আর আমি অবশ্যই মহা প্রশস্তকারী। (আয-যারিয়াত ৫১: ৪৭)

মানুষ কর্তৃক টেলিষ্কোপ আবিষ্কারের পূর্বেই কোর’আন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কথা জানিয়েছে। অনেকেই বলতে  পারেন যে, আরবরা যেহেতু জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রসর ছিল, সেহেতু কোর’আনে জ্যোতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত সত্যের বিবরণ আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু আমরা দেখি যে, জ্যোতির্বিদ্যায় আরবদের অগ্রসরতার কয়েক শতাব্দী পূর্বে কোরআন নাযিল হয়েছিল। এমনকি আরবরা তাদের বৈজ্ঞানিক শৌর্যবীর্যের যুগেও বিগ ব্যাং থিওরি সম্পর্কে কিছুই জানত না।  

 

৩. পৃথিবী দেখতে কেমন?

প্রথম যুগের মানুষরা বিশ্বাস করত যে, পৃথিবী চেপ্টা ছিল। স্যার ফ্রনকিস ড্র্যাক প্রথম প্রমাণ করেন যে, পৃথিবী গোলাকার। তিনি ১৫৯৭ সনে পৃথিবীর চারপাশে নৌভ্রমণ করেন। আমরা দিবা রাত্রির আবর্তন সর্ম্পকিত  কোর’আনের নিন্মোক্ত আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করলে বুঝতে পারবো যে কোর’আনও ঠিক একই কথা বলছে,

তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ রাত্রিকে দিনে এবং দিনকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রত্যেকেই বিচরণ করছে নির্দিষ্টকৃত সময় অনুযায়ী, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত। (লুকমান ৩১: ২৯)

এখানে আমরা বুঝতে পারি যে, রাত ক্রমান্বয়ে দিনে রূপান্তরিত হয়, অনুরূপভাবে দিনও ক্রমান্বয়ে রাতে পরিবর্তিত হয়। পৃথিবী গোলাকৃতির হলেই কেবল এ ঘটনা ঘটতে পারে ।

অন্য একটি আয়াত দ্বারাও পৃথিবী যে গোলাকার তা বুঝা যায়। মহান আল্লাহ বলেন :

তিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। রাত দিনকে ঢেকে নেয়, আর দিন ঢেকে নেয় রাতকে। তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন সূর্য আর চাঁদকে, প্রত্যেকেই চলছে নির্দিষ্ট সময় অনুসারে। জেনে রেখ, তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল। (আয-যুমার ৩৯: ৫)

পৃথিবী দেখতে পুরোপুরি গোলাকার নয়, বরং কমলালেবুর মত উপর ও নিচের দিকটা কিছুটা চাপা এবং মধ্যভাগ (নিরক্ষরেখার কাছাকাছি) স্ফীত। এ ধরণের স্ফীতি তৈরি হয়েছে নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে এটির ঘূর্ণনের কারণে। একই কারণে বিষুব অঞ্চলের ব্যাস মেরু অঞ্চলের ব্যাসের তুলনায় প্রায় ৪৩ কি.মি. বেশি। নিম্নের আয়াতে পৃথিবীর আকৃতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

অতঃপর তিনি যমীনকে বিস্তীর্ণ করেছেন। (আন-নযি‘আত ৭৯: ৩০)

এখানে মূল আরবি শব্দ دحو এর দুটো অর্থ আছে। একটি অর্থ হলো উঠপাখির ডিম। অর্থাৎ উটপাখির ডিমের আকৃতির মতই পৃথিবীর আকৃতি মেরুকেন্দ্রিক চেপ্টা । অন্য অর্থ হল ‘সম্প্রসারিত করা’। উভয় অর্থই বিশুদ্ধ। কোর’আন এভাবেই পৃথিবীর আকৃতি বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেছে। অথচ কোর’আন যখন নাযিল হয় তখন প্রচলিত ধারণা ছিল- পৃথিবী চেপ্টা।  

 

৪. পৃথিবী ঘুরে নাকি সূর্য ঘুরে :

পৃথিবী ঘুরে না সূর্য ঘুরে নাকি দুটিই ঘুরে? এরিস্টটল ও টলেমী বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী একদম স্থির আর সূর্য  সহ সব গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘুরছে পৃথিবীর চারদিকে। এ মতবাদটি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞান হিসেবে টিকে ছিল। এরপর কুপার্নিকাস ও গ্যালিলিও চার হাজার বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক থিওরিকে বাতিল করে দিয়ে বললেন,

পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যের চারিদেকে প্রদক্ষিণ করছে। মাত্র ২৫ বছর আগেও বিজ্ঞান মানুষকে জানাচ্ছিল সূর্য স্থির থাকে, এটি তার নিজ অক্ষের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে না। কিন্তু আজ এটা প্রমাণিত যে পৃথিবী ও সূর্য  দুটোই গতিশীল। আর এদের দুজনের রয়েছে আলাদা কক্ষপথ। চলুন দেখি দেড় হাজার বছর আগের কোর’আন এই সর্ম্পকে কি বলে, আল্লাহ বলেন:

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন, সূর্য আর চন্দ্র, প্রত্যেকেই তার চক্রাকার পথে সাঁতার কাটছে। (আল-আম্বিয়া ২১: ৩৩)

আয়াতে يسبحون শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা سبح থেকে এসেছে। শাব্দিক অর্থ সাঁতার কাটা। এ শব্দটি কোন  জিনিসের গতি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। আপনি যমীনে কোন ব্যাক্তির জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করলে এর অর্থ  এটা নয় যে, তিনি গড়াগড়ি দিচ্ছেন। বরং এর অর্থ হবে তিনি চলছেন বা দৌড়ান। আর পানিতে অবস্থানকারী কোন ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করলে এর অর্থ তিনি ভাসেন হবে না। বরং এর অর্থ হবে, তিনি সাঁতার কাটেন। অনুরূপভাবে আপনি যদি শব্দটি আকাশ সম্পকির্ত কোন জিনিস যেমন সূর্য বা চন্দ্র সম্পর্কে ব্যবহার করেন, তখন এর অর্থ মহাশূন্যে উড়া নয়। বরং এর অর্থ হল তা মহাশূন্যে আবর্তিত হয়।  

 

৫. চাঁদ ও সূর্যের স্বতন্ত্র কক্ষপথ :

এইতো মাত্র কিছু দিন আগে আধুনিক জ্যোতিষ শাস্ত্র আবিষ্কার করেছে যে, চাঁদ ও সূর্যের স্বতন্ত্র কক্ষপথ আছে এবং সেগুলো নিজস্ব গতিতে মহাশূন্যে ভ্রমণ করছে।

সূর্য সৌরজগতকে নিয়ে যে নিদির্ষ্ট স্থানের দিকে চলছে, সে স্থানটি আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র সঠিকভাবে আবিষ্কার করেছে। এর নামকরণ করা হয়েছে সৌর শৃঙ্গ বা Solar Apex। পৃথিবী চারদিকে ঘুরতে যতটুকু সময় ততক্ষণে চাঁদ নিজ কক্ষপথে একবার আবর্তন করে। একবার ঘুরে আসতে তার সাড়ে ২৯ দিন সময় লাগে।

আল্লাহ কোর’আন মজীদে বলেন,

আর সূর্য তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া জায়গায় গতিশীল, এটা মহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের সুনিরূপিত নির্ধারণ। (ইয়াসীন ৩৬: ৩৮)

 

তিনি আরো বলেন :

সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদকে ধরে ফেলা, আর রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে ছাড়িয়ে আগে বেড়ে যাওয়া, প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষ পথে সাঁতার কাটছে। (ইয়াসীন ৩৬: ৪০)

কোর’আনের আয়াতের বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সম্পর্কে যে কেউ আশ্চর্য না হয়ে পারেনা। সুবহানআল্লাহ।  

 

জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছুদিন পূর্বেও মানুষ যে সমস্ত তথ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ছিল, জ্ঞান সাধনার ফলে তার অনেকটাই আজ সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছে। তবে এখনও এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যার প্রকৃত অর্থ অনুধাবনের জন্য আরও উন্নততর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। এভাবেই পবিত্র কোর’আনে উল্লেখিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি যুগ যুগ ধরে মানুষকে সঠিকভাবে জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনার প্রতি উৎসাহিত করে আসছে। পরিশেষে, আল্লাহ যেন এই সামান্য প্রচেষ্টাটুকু কবুল করেন। আমরা তাঁর ক্ষমা ও হেদায়াত প্রার্থী।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিজ্ঞান বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পর...

বিজ্ঞান | 2018-07-01 03:21:51

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

বিজ্ঞান | 2018-07-14 00:00:36

শাইখ আল-রাইস শরীফ আল-মুলক আবু আলী আল-হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন আল-হাসান...

বিজ্ঞান | 2018-10-11 23:45:28

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ ট...

বিজ্ঞান | 2018-03-30 10:24:15

আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অব...

বিজ্ঞান | 2018-07-27 06:06:44

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও...

বিজ্ঞান | 2017-11-12 21:00:39

 "কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্...

বিজ্ঞান | 2021-09-17 14:11:09

ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোব...

বিজ্ঞান | 2017-10-28 11:12:25