লোহার মহাজাগতিক উৎস


জগলুল আল-নাজ্জার; আবরার শেখ
Published: 2021-12-07 20:56:52 BdST | Updated: 2024-05-14 03:52:35 BdST

পবিত্র কুরআনে সূরা হাদীদ (লোহা) নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে। এর ২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

….আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার….

 

এই আয়াত থেকে আমরা দুইটি বিষয়ে পাই। প্রথমত, লোহা পৃথিবীর বাহির থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ লোহার উৎস মহাজাগতিক। দ্বিতীয়ত, লোহা এমন একটি ধাতব পদার্থ যার ব্যবহারে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি এবং মানুষ এটা থেকে বহুবিধ উপকার পেতে পারে।  

আমরা জানি, পৃথিবীর মোট গঠনের ৩৫ শতাংশ লোহা এবং ভূত্বকের আবরণে লোহার পরিমান ৫.৬ শতাংশ। পৃথিবীতে আমাদের এই পর্যবেক্ষণ থেকে আমাদের এই ধারণা হতে পারে, পৃথিবীর মজুদকৃত লোহার অধিকাংশই এর অভ্যন্তরে লুকিয়ে রয়েছে।  

এই ধারণা যদি সত্য হয়, তবে কুর’আনে বর্ণিত লোহার মহাজাগতিক উৎস হওয়ার তত্ত্বের সাথে আমাদের পর্যবেক্ষণ সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।  

এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই আমাদের পৃথিবীকে এই মহাবিশ্বের বর্হিভূত বিচ্ছিন্ন কোন গ্রহ নয়, বরং মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরী। আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানীরা নতুন করে দেখিয়েছেন,

এক. সমগ্র মহাবিশ্বে সর্বাধিক হালকা পদার্থ হাইড্রোজেন গ্যাস, যেটির পরিমাণ মহাবিশ্বে অন্যন্য পদার্থের তুলনায় সর্বাধিক।  

দুই. হাইড্রোজেনের পরপরই যে পদার্থটির পরিমাণ পৃথিবীতে সর্বাধিক তা হলো হিলিয়াম।  

তিন. হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের সংমিশ্রণেই সমগ্র মহাবিশ্বের বৃহদাংশ গঠিত। এর বিপরীতে অন্যান্য ভারি পদার্থ সমূহের পরিমাণ মোট ভরের ১ থেকে ২ শতাংশ মাত্র।  

এই আবিষ্কার থেকে আমরা ধা্রণা গ্রহণ করতে পারি, মহাবিশ্বের সকল পদার্থসমূহ প্রধানত হাইড্রোজেনের  সংমিশ্রণেই গঠিত হয়েছে। এই পদার্থসমূহ হাইড্রোজেন থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে স্বনিয়ন্ত্রিত একটি প্রক্রিয়া, যেটি তাপ ও শক্তির ক্ষরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।  

সূর্যের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় প্রধানত হিলিয়াম তৈরি হয়। একইসাথে খুবই অল্প পরিমাণে হিলিয়াম হতে সামান্য ভারী পদার্থসমূহও তৈরি হয়ে থাকে। সূর্যে বিদ্যমান লোহার পরিমাণ তার মোট আয়তনের ০.০০৩৭ শতাংশ। জেনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীসহ আমাদের সৌরজগতের সকল গ্রহ ও উপগ্রহ সূর্য থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সূর্যে কোন প্রকার লোহার উৎপাদন হয়না। সুতরাং প্রশ্ন আসতে পারে, পৃথিবীতে এতো অপরিমেয় লোহার উৎস কোথা থেকে আসে?

তাপ ক্ষরণের মাত্রার বিবেচনায় সূর্য একটি মধ্যবর্তী নক্ষত্র। সাধারণভাবে এর উপরিতলের তাপমাত্রা ৬,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এর অভ্যন্তরের সাধারণ তাপমাত্রা ১,৫০,০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লোহার গঠনের জন্য এরূপ তাপমাত্রা যথেষ্ট নয়।   

ঘটনাচক্রে, লোহার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রাসম্পন্ন বিকল্প উৎস বিদ্যমান রয়েছে। সম্ভাব্য একটি উৎস হতে পারে, ‘বিগব্যাঙ’ এর মহাবিস্ফোরণ যার মাধ্যমে অত্যাধিক তাপ নিঃসরণের মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীসহ এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটেছে।

কিন্তু সকল পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, বিগব্যাঙের পরবর্তীতে শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামেরই আবির্ভাব ঘটেছে। যদি লোহার উৎপত্তি তখন হতো, তবে মহাবিশ্বের সর্বত্রই সমানভাবে লোহার সন্ধান পাওয়া যেতো। কিন্তু তার কোন প্রকার চিহ্নই বিদ্যমান নেই।

বিগব্যাঙের এক সেকেন্ড পরবর্তী সময়ে, মহাবিশ্বের সূচনায় তাপমাত্রা দশ বিলিয়ন ডিগ্রির অধিক হয়ে পড়েছিলো। এই সময়কার বিশ্বের গঠনকে যদি আমরা কল্পনা করি, তবে দেখতে পারি একটি স্থিরভাবে সম্প্রসারণশীল ধোঁয়ার মেঘ, যেটি প্রাথমিক রূপের পদার্থ ও শক্তির সমন্বয়ে গঠিত।

প্রাথমিক উষ্ণ তাপমাত্রার বিশ্বে ফোটনের আকৃতিতে বিকিরণ অব্যাহত ছিল, যা সর্বত্রই সমান শক্তির সাথে অবস্থান করছিলো।  

গ্যামভের এই তত্ত্বটি (১৯৪৮) পরবর্তীতে পেনিজাস ও উইলসন (১৯৬৫) সত্য প্রমাণিত করেন। তারা তাদের কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন তত্ত্বের মাধ্যমে দেখান মহাবিশ্বের সর্বত্রই সমপরিমাণ শক্তি নিয়ে বিকিরণ সংগঠিত হয়।

আমাদের মহাবিশ্বের সূচনার প্রথম তিন মিনিটে নিউট্রনসমূহ প্রোটন বা ইলেকট্রন দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় অথবা অন্যান্য নিউট্রনের সাথে একত্রিত হয়ে ডিউটেরিয়াম বা ভারী হাইড্রোজেনের উদ্ভব ঘটায়। যা পরবর্তীতে হিলিয়ামের উদ্ভব ঘটায়।

এর পরবর্তীতে হিলিয়াম কিছু লিথিয়ামের উদ্ভব ঘটাতে পারে, কিন্তু বিগব্যাঙ থেকে এর থেকে অধিক ভারী কোন পদার্থের উদ্ভব ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই।

সুতরাং বলা যায়, মহাবিশ্বের সূচনালগ্নে বিগব্যাঙের পরপরই যে পদার্থসমূহের আবির্ভাব ঘটে তা হলো অধিকাংশই হাইড্রোজেন এবং কিছু হিলিয়াম। পরবর্তীতে হাইড্রোজেনের দহনে তা থেকে আরো হিলিয়ামের আবির্ভাব ঘটে।

তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হলে ইলেকট্রনসমূহ পরমাণুর গঠন করে যারা একত্রিত হয়ে একটি প্লাজমার গঠন করে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্লাজমাগুলো যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি অর্জন করে হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে পরিণত করতে পারে। এই প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় যথেষ্ট ভর ও শক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়।   

সম্প্রতি প্রমাণ করা হয়েছে, আমাদের সূর্যের থেকে দশগুণ বেশী ভরসম্পন্ন নক্ষত্রসমূহে তাদের উন্নতির শেষ পর্যায়ে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে লিথিয়ামের থেকে অধিক ভারী বিভিন্ন পদার্থের উদ্ভব ঘটে। অধিক ভরসম্পন্ন এই নক্ষত্রসমূহে হিলিয়াম পুড়ে কার্বন, অক্সিজেন, সিলিকন, সালফার এবং সর্বশেষ লোহার উদ্ভব ঘটেছে।   

লোহার যখন উদ্ভব ঘটে, নক্ষত্রসমূহের নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়া তখন আর অব্যাহত থাকতে সক্ষম হয়না। লোহার থেকে ভারী পদার্থসমূহের উদ্ভব কিছু দানবিক নক্ষত্রসমূহে  ঘটতে পারে অথবা নক্ষত্রসমূহের বিস্ফোরণ বা সুপারনোভার মাধ্যমে এই ভারী পদার্ধ সমূহের উদ্ভব ঘটে।

এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, মহাবিশ্বের বিভিন্ন নক্ষত্রসমূহ মহাজাগতিক ওভেন, যেখানে বিভিন্ন পদার্থসমূহ হাইড্রোজেন থেকে বা হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের সমন্বয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়। একইসময়ে নক্ষত্র থেকে অবিশ্বাস্য পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হালকা  উপাদানগুলোকে ভারী উপাদানগুলোর সাথে সমন্বিত করে।

এধরনের প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন হয় বিভিন্ন পদার্থসমূহের মধ্যে উচ্চগতিসম্পন্ন সংঘর্ষের, যা শুধু উচ্চতর তাপমাত্রাতেই সম্পন্ন হতে পারে। এই ধরনের সংঘর্ষের জন্য প্রয়োজন হয় কমপক্ষে ৫০,০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে উৎপন্ন পদার্থসমূহের পরমাণুর ভর বৃদ্ধির সাথে সাথে এই তাপমাত্রারও বৃদ্ধি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, হাউড্রোজেন থেকে কার্বনে রূপান্তরের জন্য নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় এক বিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন।  

নক্ষত্রের জীবনকালেই নক্ষত্রে মজুদ হাইড্রোজেন পুড়ে হিলিয়ামে পরিণত হয়। সব হাইড্রোজেন যখন পুড়ে  শেষ হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হয়, তখন নক্ষত্রটি তার দানবিক আকৃতি থেকে পরিবর্তিত হয়ে বামন গ্রহে পরিণত হয় অথবা আরো বৃহদাকৃতির দানবে পরিণত হয়। তখন এটি তার সঞ্চিত হিলিয়ামসমূহকে পোড়ানো শুরু করে, যতক্ষণনা তার মধ্য হতে বিভিন্ন ভারী পদার্থ বা লোহার আর্বিভাব না ঘটে।

এই প্রক্রিয়াচলাকালীন নক্ষত্রসমূহে অপরিমেয় পরিমাণ শক্তির নিঃসরণ ঘটে। এই শক্তির নিঃসরণ ঘটাতে  গিয়ে যখন নক্ষত্র তার শক্তির সঞ্চয় নিঃশেষ করে ফেলে এবং তার মধ্যকার বিভিন্ন পদার্থের সাথে লোহার আর্বিভাব ঘটে, তখন নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণ সুপারনোভা নামে পরিচিত।

সুপারনোভা সংগঠনের অব্যবাহিত পূর্বে লোহার আর্বিভাব ঘটে। লোহার অধিক ভরসম্পন্ন পদার্থসমূহ সুপারনোভা সংগঠনের সময় গঠিত হয়।

সুপারনোভা সংগঠনের পর লোহাসহ এই ভারী পদার্থগুলো মহাবিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে পরবর্তীতে এই ভারী পদার্থসমূহ আপতিত হয়।

সুতরাং, এই বিশ্লেষন থেকে আমরা লোহার মহাজাগতিক উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি।

 

উৎসস

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিজ্ঞান বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পর...

বিজ্ঞান | 2018-07-01 03:21:51

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

বিজ্ঞান | 2018-07-14 00:00:36

শাইখ আল-রাইস শরীফ আল-মুলক আবু আলী আল-হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন আল-হাসান...

বিজ্ঞান | 2018-10-11 23:45:28

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ ট...

বিজ্ঞান | 2018-03-30 10:24:15

আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অব...

বিজ্ঞান | 2018-07-27 06:06:44

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও...

বিজ্ঞান | 2017-11-12 21:00:39

 "কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্...

বিজ্ঞান | 2021-09-17 14:11:09

ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোব...

বিজ্ঞান | 2017-10-28 11:12:25