আলকেমি থেকে কেমেস্ট্রি: রসায়নের জন্মকথা
1001 inventions অবলম্বনে
Published: 2022-07-18 19:11:36 BdST | Updated: 2024-05-15 04:46:51 BdST
রসায়ন সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে, তাদের সকলের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের তাদের ভরের ক্রমানুসারে সন্নিবেশিত একটি সারণীর সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। পর্যায় সারণী হিসেবে পরিচিত এই সারণীতে হাইড্রোজেন থেকে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত বিভিন্ন উপাদানের সন্নিবেশন করা হয়েছে। যদি এটি আর একটু হাল নাগাদ করা হয়, তবে এতে এমন অনেক রাসায়নিক উপাদানের নাম পেতে পারেন, যার নাম আপনি হয়তো এখনো শুনেননি। রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডিলেফ প্রথম এই সারণীটি সন্নিবেশিত করেন। পর্যায় সারণীতে উল্লিখিত সকল প্রকার উপাদান মূলত পৃথিবীতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রকার পরমাণুর অস্তিত্বকে প্রকাশ করে, যা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে পারেন কি করে এ সকল পরমাণু একত্রিত হয়ে আমাদের পৃথিবী এবং অন্যান্য সকল সৃষ্টি তৈরি করেছে। বিভিন্ন রাসায়নিক পরমাণুর পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমে নতুন একটি উপাদানের সৃষ্টির বিশ্লেষণই আজকের কেমেস্ট্রি (Chemistry) বা আধুনিক রসায়নবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু কখন ও কিভাবে রসায়ন বিজ্ঞানের এই আলোচনার আবির্ভাব হল?
প্রাচীন গ্রীকরা পৃথিবীর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পৃথিবীর সৃষ্টির মূল উপাদান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, তারা সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা বরং অধিক জটিলই করেছিল।
এর এক হাজার বছর পরে, অষ্টম শতাব্দীতে একজন ব্যক্তির আর্বিভাব হল যিনি সম্পূর্ণ জটিলতার সমাধান করেন। বর্তমান ইরাকের কুফায় বসবাসকারী এই ব্যক্তি হলেন জাবির ইবনে হাইয়ান। তৎকালীন সময়ে কুফা ছিল ইসলামী খেলাফতের অধীন একটি বহুজাতিক শহর, যেখানে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করতো।
তৎকালীন মধ্যযুগে রসায়নের চর্চা ছিল বিভিন্ন উপাদানের অজানা রহস্যপূর্ণ মিশ্রণের খেলা। আলকেমি নামে পরিচিত এই রহস্যপূর্ণ বিজ্ঞানে পূর্ববর্তী কোন ধারণা ছাড়াই বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণের পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হত। এসকল পরীক্ষা-নিরিক্ষার পূর্ণাঙ্গ লিপিবদ্ধ করে রাখারও কোন অনুশীলন আলকেমির চর্চাকারীদের মধ্যে ছিলনা। জাবির প্রথমবারের মত এসকল পরীক্ষা-নিরিক্ষা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং সতর্কতার সাথে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা সম্পন্ন করেন। রাসায়নিক গবেষণায় তার সতর্ক ও পরিপূর্ণ অনুশীলনের কারনে তাকে পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত রসায়নবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রসায়নের গবেষণাগারে আমরা টেস্টটিউব সহ বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জাম ব্যবহার করি, যার অধিকাংশই জাবির ইবনে হাইয়ানের হাতে উদ্ভাবিত ও উন্নতকরণ করা হয়। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাচীনকালের বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও তিনিই মধ্যযুগীয় মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের বৈজ্ঞানিকদের অগ্রপথিক। এছাড়া প্রাচীন চীনা বিজ্ঞানীদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন, যারা কাগজের মত মূল্যবান একটি উপাদান আবিষ্কার করেছিলেন। যার ফলে বইয়ের মাধ্যমে পরবর্তী যুগের নবীন বিজ্ঞানীদের জন্য পূর্ববর্তীদের কাজ পৌছানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন পদার্থ তৈরির মৌলিক রাসায়নিক উপাদানের মধ্যকার অনেকগুলো উপদানই জাবিরের হাত ধরে উদ্ভাবিত হয়। তার দুইশত বছর পরে অপর একজন রসায়নবিদ আল-রাজী রসায়নের চর্চাকে নিয়ে যান অন্য এক উচ্চতায়।
আল-রাজী তার রচিত ‘Book of Secretes’এ তিনি রাসায়নিক উপাদানের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদার্থের সতর্ক সন্নিবেশন করেন। প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানের চার মৌলিক উপাদানের আলোচনা থেকে এটি ছিল আরো বৃহৎ পরিসরের।
জাবির ইবনে হাইয়ান ও আল-রাজীর রচনাসমূহ পরবর্তীতে আরবি থেকে ল্যাটিনে অনূদিত হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তাদের আলোচনার উপর ভিত্তি করে আজকের পর্যায় সারণীর উদ্ভব সহ আধুনিক রসায়নবিজ্ঞানের বিভিন্ন নতুন নতুন গবেষণা সম্পন্ন হচ্ছে।
জাবির ইবনে হাইয়ানের গবেষণার পথ ধরেই আজকে আমরা ১১৮ টি নতুন মৌলিক উপাদানের নাম পেয়েছি এবং এই সংখ্যাটি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত তার হাত ধরেই একটি রহস্যপূর্ণ অনুশীলন একটি সত্যিকার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পরিণত হয়েছে।
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: