কুরআনের বৈজ্ঞানিক নিদর্শন (১ম পর্ব)  


নুর জিহান; অনুবাদ- মুহাম্মদ আল বাহলুল
Published: 2018-03-30 10:24:15 BdST | Updated: 2024-05-14 12:34:08 BdST

Photo Credit:IslamiCity

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ টি আয়াতে মাত্র তিনশতটির  মতো আয়াতে বিভিন্ন বিধিনিষেধের আলোচনা করা হয়েছে। আর বাকি বিভিন্ন আয়াতে মানুষের বোধগম্যতার জন্য বিভিন্ন উদাহরণ প্রদান করা হয়েছে। অতীতের নবী রাসূলদের সংগ্রাম এবং তাদের জাতির অবাধ্যতার ইতিহাসের পাশাপাশি এই গ্রন্থে ইঙ্গিত করা হয়েছে আল্লাহর এই বিশাল সৃষ্টি জগতের দিকে। মানুষকে পথপ্রদর্শনের জন্য কুর’আনে এরূপ বিবিধ নিদর্শনের উল্লেখ কুর’আনকে পরিণত করেছে ‘নিদর্শনের গ্রন্থে’।  

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে হচ্ছে মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আর তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রুম, আয়াত- ২২)

তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। (সূরা রাদ, আয়াত-২)

আল্লাহর নির্দেশিত পথে মানুষকে চলার গুরুত্বস্বরূপ কুর’আনে বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে বিভিন্ন নিদর্শনসমূহের উল্লেখ  করা হয়েছে। রাসূল (সা.) এর সময় তৎকালীন বিজ্ঞানচর্চা ছিলো একদম প্রাথমিক পর্যায়ের। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত অগ্রসরতায় কুর’আনের এই ‍নিদর্শনগুলো আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। পূর্বে যে বিষয়সমূহ  মানুষের বোধগম্যতার অতীত ছিলো, আধুনিক বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে তার ব্যাখ্যা মানুষের সামনে পরিষ্কার হচ্ছে।

কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কুর’আনে উল্লেখিত এই নিদর্শনগুলো সীমাবদ্ধ নেই, বরং মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে ভূগোল, উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কুর’আনের উদাহরণসমূহ বিবৃত করা হয়েছে।   

১. মহাবিশ্বের উৎপত্তি

কোথা থেকে এই মহাবিশ্বের আবির্ভাব, পৃথিবীর সকল যুগের মানুষের কাছেই এটি ছিলো তীব্র আগ্রহের বিষয়। প্রাথমিক দৃষ্টিতে কুর’আনে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ মনে হতে পারে।

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এই মহাবিশ্বের বয়স কমপক্ষে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। কুর’আনে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ এই মহাবিশ্ব ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে।  

নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন।… (সূরা আরাফ, আয়াত-৫৪)  

কুর’আনে মূল যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো (أَيَّامٍ) ‘আইয়াম’। এই আইয়াম শব্দটির অনুবাদ বিভিন্ন অর্থে হতে পারে। এর অর্থ হতে পারে ‘কাল’, ‘যুগ’, বা নির্দিষ্ট একটি পরিব্যাপ্তির সময়।   

আমরা যদি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্বটি অর্থাৎ ‘বিগব্যাঙ তত্ত্ব’ সম্পর্কে আলোচনা করি, তবে আমরা দেখতে পারি যে, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে ছয়টি নির্দিষ্ট ধাপের মধ্য দিয়ে। এই ছয়টি নির্দিষ্ট ধাপ হচ্ছে,

১. মহাবিস্ফোরন (Big Bang)

২. স্ফীতি (Inflation)

৩. উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বস্তুকণার প্রতিক্রিয়া (High energy particle reactions)

৪. পরমাণুর গঠন (First formation of nuclei)

৫. অণুর গঠন (First formation of atom)

৬. ছায়াপথ ও নক্ষত্রসমূহের আর্বিভাব (First formation of galaxies and stars)

সময়ের আপেক্ষিকতার দৃষ্টিতে বলা যায়, প্রথম চারটি ধাপ খুবই কম সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। যা ২৪ ঘন্টার দিনের ধারণার বিপরীত। সুতরাং, কুর’আনে উল্লেখিত আইয়াম শব্দটির অর্থ শাব্দিক ২৪ ঘন্টার দিন না হয়ে এর অর্থ আমরা  একটি অনির্দিষ্ট পরিব্যাপ্তিসমূহের সময়কে নির্দিষ্ট করতে পারি।

আধুনিক বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার কুর’আনের উপরোক্ত আয়াতটিকে আমাদের বোধগম্যতার জন্য সহজ করে দিয়েছে।  

২. জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি

কুর’আনে বলা হয়েছে,

সকল মহিমা তাঁর যিনি জোড়ায়-জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবী যা উৎপাদন করে তার মধ্যের সবকিছু, আর তাদের নিজেদের মধ্যেও, আর তারা যার কথা জানে না তাদের মধ্যেও। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত-৩৬)  

এই আয়াতের স্পষ্ট নিদর্শন আমরা পৃথিবীতে লক্ষ্য করি জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন সৃষ্টির অবস্থান থেকে। কুরআনে ১৪০০ বছর পূর্বে এই বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করেছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়েছে।  

‘আর আকাশ থেকে তিনি বর্ষণ করেন পানি, তারপর তিনি এতে উৎপাদন করেন সব রকমের হিতকর জোড়া।’ (সূরা লুকমান, আয়াত-১০)   

‘আর তিনি আকাশ থেকে পাঠান পানি। তারপর এর দ্বারা উৎপাদন করেন জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন ধরণের গাছপালা।’ (সূরা ত্বাহা, আয়াত-৫৩)   

কুর’আনের এই আয়াতসমূহের আর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে ‘সমতার ধারণা’, যার জন্য ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পল ডুয়ার্ক  নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন। তিনি ধারণা প্রদান করেন, এই বিশ্বের প্রতিটি বস্তুরই একটি প্রতিবস্তু রয়েছে। এই প্রতিবস্তুটি বস্তুর সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু বস্তুটির বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।  

বস্তু ও প্রতিবস্তু সর্বদা একত্রেই জোড়া হিসেবে সৃষ্টি হয়। তারা একইসঙ্গে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে অবস্থান করে।

৩. কক্ষপথসমূহের অবস্থান এবং সূর্যের পরিণতি  

সৌরজগত সম্পর্কে কুর’আনে বর্ণিত নিদর্শন আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে প্রমানিত হয়েছে। কুর’আনে প্রায়শই মানুষকে বোঝানোর স্বার্থে আল্লাহ তার বিভিন্ন সৃষ্টি সম্পর্কে শপথ করে সেই সৃষ্টিটি সম্পর্কে চিন্তাভাবনার জন্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তেমনি ভাবে আল্লাহ শপথ করেছেন নিম্নের আয়াতে,   

পথবিশিষ্ট আকাশের শপথ (সূরা যারিয়াত, আয়াত-৭)

চক্রশীল আকাশের শপথ(সূরা তারিক, আয়াত-১১)

টেলিস্কোপের আবিষ্কার এবং জ্যোর্তিবিজ্ঞানের আধুনিক অগ্রগতির পূর্বে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন এবং কক্ষপথ  সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিলোনা। কুর’আন নাযিলের বহু পরে গিয়ে আধুনিক মানুষ বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন এবং তাদের কক্ষপথ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে।  

এছাড়া কুরআনের সূরা ইয়াসিনের ৩৮ নং আয়াতের নির্দেশনা অনুসারে সূর্যের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আবর্তনের ইঙ্গিত থেকে এটিই স্পষ্ট হয়, সূর্যের এই ছুটে চলা একদিন শেষ হয়ে যাবে। কুর’আনে ১৪০০ বছর পূর্বে এই সম্পর্কে ইঙ্গিত  প্রদান করলেও আধুনিক বিজ্ঞান মাত্র কিছুদিন পূর্বে এই সম্পর্কে আবিষ্কার করেছে।

এখন থেকে আরো প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের অভ্যন্তরীন হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। ফলে সূর্যে আর তাপ এবং আলো সৃষ্টির কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে সূর্য তার তাপ হারিয়ে একটি শীতল অন্ধকারাচ্ছন্ন বামন গ্রহে পরিণত হবে।

কিয়ামতের নিদর্শন হিসেবে কুর’আনে সূরা তাকভিরে সূর্যের অন্ধকারাচ্ছন্নকতার দিকে নির্দেশ করা হয়েছে। সূরা  তাকভিরের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে,

যখন সূর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে।

 উৎস   

দ্বিতীয় পর্ব

 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিজ্ঞান বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চায় পুরুষদের অবদান সম্পর্কে বিপুল পর...

বিজ্ঞান | 2018-07-01 03:21:51

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

বিজ্ঞান | 2018-07-14 00:00:36

শাইখ আল-রাইস শরীফ আল-মুলক আবু আলী আল-হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন আল-হাসান...

বিজ্ঞান | 2018-10-11 23:45:28

কুর’আনের ১১৪টি সূরা বিবিধ বিষয়ে আলোচনার দাবী রাখে। কুর’আনের মোট ৬২৩৬ ট...

বিজ্ঞান | 2018-03-30 10:24:15

আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অব...

বিজ্ঞান | 2018-07-27 06:06:44

ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও...

বিজ্ঞান | 2017-11-12 21:00:39

 "কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্...

বিজ্ঞান | 2021-09-17 14:11:09

ডঃ সালাম, খুব ভালো একটা বিষয় আপনি আলোচনা করেছেন, তবে আপনি আমার মত মনোব...

বিজ্ঞান | 2017-10-28 11:12:25