রমজান: নফসকে অতিক্রম করে প্রভুর দিকে


আহমেদ বিন কাসিম
Published: 2023-04-01 23:54:11 BdST | Updated: 2024-05-15 12:46:49 BdST

রমজান এসেছে — এবং এই মাসটিকে বস্তুকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতার ধারণায় নামিয়ে ফেলার প্রবণতা থেকে বিরত থাকা মুসলমানদের জন্য আগের চে’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । নিশ্চয়ই রোযার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যগত ও পার্থিব উপকারিতা, তবে শুধু সেই দিকগুলির উপরই অতিগুরুত্ব দেওয়া এবং সেগুলোকেই কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য বানানোর প্রবণতা রমজানের প্রাণ ও এর পিছনের উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করে। ইসলামী রেয়াজগুলোকে বস্তুগত বা ব্যক্তিবাদী কল্যাণপ্রেরণার দিকে নামিয়ে আনার মানে হলো ইসলামকে পুনর্নির্মাণ করে কার্যত একে একটি উদারনৈতিক (লিবারেল) রূপ দেয়া। আসলে এই উপবাস ব্যক্তির মধ্যে এক সত্য-সচেতন সত্তা গড়ে তোলে যে : যখন আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেন, তখন আমাদের কোনোপ্রকার খাদ্য, পানি ও যৌনতার অধিকার থাকবে না । ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও এগুলো দূর করতে না পারার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের আত্মার ভেতরে আল্লাহর চূড়ান্ত ক্ষমতার স্বীকৃতিকে মজবুত করা। আলী হারফুশ-এর মতে, রোজা রাখা আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন নয়, বরং এটি হল মানুষ হিসেবে আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাকে স্বীকৃতি দেয়ার একটি উপায় । 

শেরম্যান জ্যাকসন নব্য নৃ-রূপান্তরবাদ (new anthropomorphism) এর ধারণাটি সম্পর্কে বলেছেন: এটি এমন একটি অবস্থা বা শর্ত যেখানে আমরা রূপ (ফর্ম)-কে নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছার ওপর মানুষের ইচ্ছাকে অধিষ্ঠিত করি। এর অধীনে, রমজান আল্লাহর জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে মানুষের নিজের জন্য কাজ করার এক প্রকল্পে রূপান্তরিত হয় । শেরম্যান জ্যাকসনের মতে, "এই নৃ-রূপান্তরবাদ এই দুনিয়াতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের উপকারিতা বা এমনকি আনন্দ খুজে পাওয়ার নিছক প্রচেষ্টারও ঊর্ধ্বে। এমনকি এটি মানুষের চাহিদা ও সেই চাহিদার সাথে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সমন্বয় করার প্রচেষ্টার অনেক ঊর্ধ্বে।" বরং এই নৃ-রূপান্তরবাদের অন্তর্নিহিত ধারণা হচ্ছে, মানুষ যা চায়, আল্লাহও তা’ই চান, আর মানুষ যা চায় না, আল্লাহ তা চান না। এই নৃতাত্ত্বিকতা, মানুষের নিজের জন্য বাহ্যিক একটি কর্তৃত্বের প্রাধান্য (heteronomy)- কে অস্বীকার করে, এবং নিজের জন্য নিজের প্রাধান্য ও উপাসনা ( autonomy) বা স্বায়ত্তউপাসনার সুনিশ্চিতকরণকে অন্তর্ভূক্ত করে। কোরান এই দিকেই ইঙ্গিত করে সূরা আল জাছিয়াতে বলেছে, যেখানে আল্লাহ বলেন: 

তুমি কি লক্ষ্য করেছ তার প্রতি যে তার খেয়াল-খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন আর তার কানে ও দিলে মোহর মেরে দিয়েছেন আর তার চোখের উপর টেনে দিয়েছেন পর্দা। অতঃপর আল্লাহর পর আর কে (আছে যে) তাকে সঠিক পথ দেখাবে? এরপরও কি তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করবে না? (৪৫ঃ২৩)

মানুষ যা চায় আল্লাহ তা চান এবং মানুষ যা ঘৃণা করে তা ঘৃণা করেন, এটি মোটেও টেকসই ধারণা নয়। সূরা আল-বাকারায় আল্লাহ ঘোষণা করেন: “সম্ভবত তোমরা একটি বিষয়কে অপছন্দ কর এবং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; এবং সম্ভবত তোমরা একটি জিনিস পছন্দ কর এবং এটি তোমাদের জন্য মন্দ। আর আল্লাহ জানেন, অথচ তোমরা জান না।" [কোরআন ২:২১৬] এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আমাদের জন্য হাসান (ভাল) ও কাবিহ (মন্দ) সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞানের কাছে যে ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করে এবং তার নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর উপর প্রাধান্য দেয় না, একজন মুসলিম হল সে’ই - উপরের এই ধারণাটির সাথে নৃ-রূপান্তরবাদ সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহ যখন আমাদের জন্য কোন জিনিস পছন্দ করেন, তখন তা আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। যখন তিনি আমাদের জন্য একটি জিনিস অপছন্দ করেন, তখন তা আমাদের জন্য মন্দ হয়ে যায়। কোনো একটি অবস্থার ক্ষেত্রে মানুষের যে পছন্দ-অপছন্দ বেলায় কিন্তু এই একই কথা প্রযোজ্য হয় না। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠতা দাবি করে যে, যখন আল্লাহ- নির্ধারিত কোনো কিছু কীভাবে আমাদের জন্য কল্যাণকর, তা আমাদের সীমিত বুদ্ধি আবিষ্কার করতে অক্ষম হয়, তখনও আমাদেরকে তার আদেশ মানতে হবে। 

এইভাবে, রোজা প্রতিহত করে এই নৃ-কেন্দ্রিকতাকে, যা হচ্ছে নফস আল-আম্মারা-র উপর দেবত্ব-আরোপ, এটা আমাদের আত্মার ওই অংশ যা মন্দকে উদ্বুদ্ধ করে এবং আমাদেরকে মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানায়, কারণ আমাদের আত্মার এই দিকটিকেই শয়তান তার পুঁজি বানায়। সূরা ইউসুফে, হযরত ইউসুফ বলেছেন: “নফস্ তো মন্দ কাজে প্ররোচিত করতেই থাকে, আমার প্রতিপালক যার প্রতি দয়া করেন সে ছাড়া। আমার প্রতিপালক বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।" [কোরআন ১২:৫৩] অতএব, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র বাহ্যিক মন্দ নির্দেশদাতা ও অত্যাচারীদের হাত থেকেই আমাদেরকে রেহাই দেয়না, বরং তার রহমতও টেনে আনে যা আমাদেরকে নিরাপত্তা দেয় আমাদেরই অন্তর্নিহিত মন্দ থেকে, এবং বাধা দেয় আমাদের নিজেদেরই সীমালঙ্ঘনকারী হতে । কাজেই রোজা আল্লাহর চারপাশে আমাদের অস্তিত্বকে পুনঃকেন্দ্রীভূত করে, কারণ এটি আমাদেরকে শেখায় আমাদের প্রয়োজন পূরণ - এমনকি তাদের মধ্যে সবচেয়ে আদিম ও প্রাকৃতিক - এর সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির অধীন এবং তাঁর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেভাবে হারফুশ বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার এই যুগে, যা চিহ্নিত হয়েছে "ধর্মনিরপেক্ষতার" কাছে "পবিত্রতার" পরাভবে, আর জাগতিকতা পেয়েছে উচ্চতম মর্যাদার আসন, সেখানে উপবাসের মানে হল "ধর্মনিরপেক্ষতা”র সবচেয়ে মূল বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তিঃ আর তা হলো, মাংস। 

উপবাসের শারীরিক কষ্টের প্রকৃতি সম্পর্কে নৃতত্ববিদ তালাল আসাদ উল্লেখ করেছেন যে, আধুনিক সময়ে আমরা দেখতে পাই, (শারীরিক) দূর্ভোগ বা যন্ত্রণাদায়ক আঘাত হানাকে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ধর্মের বিরোধী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যন্ত্রণা একটি "মন্দ" অবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয় যা কাটিয়ে উঠতে ধর্ম আমাদেরকে সাহায্য করবে বলে আশা করা হয়। কিন্তু বেদনা-সম্পর্কিত এই ধরনের বুঝ ধর্মনিরপেক্ষ উপযোগিতাবাদের কাছে বেশি আর ইসলামের কাছে কম, যেখানে শারীরিক কষ্ট সহজাতভাবে অনৈতিক নয় এবং শারীরিক সুখও নয় মূল্যবান । যে সাময়িক যন্ত্রণা উপবাস আমাদের শরীরে চাপিয়ে দেয় তার কারণে আসলে আমাদেরকে আরও মুত্তাকী আত্মায় পরিণত হওয়ার কথা। যদিও যাকাতের লক্ষ্য হল শারীরিক শৃংখলা আনয়ন করা সেই বস্তুগত সম্পদের উপর করারোপের মাধ্যমে যে সম্পদ দ্বারা শারীরিক আরাম ও আনন্দ অর্জিত হয়, এদিকে রোজার লক্ষ্য সরাসরি সেই শরীরকে ঘিরেই, যা করারোপ করে মুমিনের মাংসের উপর, তাকে টিকিয়ে রাখা (মাংসের) পুষ্টির উপর । 

আধুনিকতা তৈরি করে এমন এক মানবসত্তা যে কিনা প্রাথমিকভাবে একজন ভোক্তা, এইভাবে, মানুষের অস্তিত্বের সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে ভোগ করা ও নিজের তাৎক্ষনিক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে ক্রিয়াশীলতার সক্ষমতা এবং বর্তমান মুহূর্তে জীবনযাপনের প্রবণতা । অন্যদিকে, রমজান হল একটি জবাব যার লক্ষ্য হল ফিতরাহের কাছাকাছি একটি মানবসত্বা তৈরি করা, এমন একটি সত্তা যা পার্থিবতার সীমায় বসবাস করে না, বরং মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কে সচেতন । এটি এমন একটি নফস যা নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন হিসেবে দাবি করে না, বরং আল্লাহর উপর তার সম্পূর্ণ নির্ভরতা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। সূরা আলাক-এ আল্লাহ বলেন, "বস্তুতঃ মানুষতো সীমালংঘন করেই থাকে, কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত বা অমুখাপেক্ষী মনে করে। " [কোরআন ৯৬:৬-৭] রমজান মানুষের অনুভবে থাকা উগ্রতার প্রতিমূর্তি ভেংগে চুরে দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমাদের কী প্রবল অভাব-হাহাকার, আর অভাব-হাহাকার মানেই হলো কত দূর্বল আর ঘাটতি বা ত্রুটিপূর্ণতা, এবং শুধুমাত্র সেই সত্তাই উপাসনা করার যোগ্য যার কোন প্রয়োজন ও অভাব নেই এবং তিনি হলেন আল্লাহ, কাইয়ুম - স্বয়ং-প্রতিপালনকারী প্রভু, এবং কাফী, যিনি সব কিছুর মালিক- তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। 

কি পদ্ধতিতে ভোক্তা নিজে কাজ করে তা বুঝা যায় বিয়ং-চুল হান’র বই Psycho-politics এ , যেখানে তিনি স্মার্ট পাওয়ার এর কথা বলেছেন। এই শক্তির কার্যকারিতা নিষেধ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে নয়, বরং আনন্দ উপভোগ ও তার পরিপূরনের মাধ্যমেই কাজ করে। হান’র মতে, এই ধরনের একটি শক্তি ‘না’ এর তুলনায় বেশিরভাগ সময়ই ‘হ্যাঁ’ বলে থাকে এবং এটি আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে অবদমনের বদলে প্রলোভনের মাধ্যমে এবং (ইচ্ছা-আকাংখা-বিত্ত) অপসারণ বা অধিকারচ্যুতির বদলে ভোগের মাধ্যমে। এটাই সেই শক্তির ধরন যা শয়তান ও নফস আল-আম্মারাহ সম্মিলিতভাবে মুমিনদের বিরুদ্ধে আরোপ করে। সূরা আল-হিজরে, আমরা আল্লাহর কাছে শয়তানের প্রতিশ্রুতির কথা শুনতে পাই যে, সে অবশ্যই অবাধ্যতাকে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং অবাধ্যতার পথকেই সুশোভিত করবে। [কোরআন ১৫:৩৯] । এরকম শক্তি আমাদেরকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয় না, বরং পুর্ব থেকেই বিরাজমান গুনাহের মেন্যু থেকে যে কোনোটি নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। এই পদ্ধতিতে, স্মার্ট শক্তি আমাদের উপর কোনোকিছু জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয় না, বরং আরও বন্ধুত্বপূর্ণ রূপ ধারণ করে। এটি নিজেকে স্বাধীনতা হিসাবে উপস্থাপন করে, যা ঐ অবস্থার আরেকটি নাম যেখানে আপনাকে আর আল্লাহকে "স্মরণ" করার ভার বইতে হয় না, এমন একটি অবস্থা যা তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনিবার্যতাকে আমাদের চোখ থেকে আড়াল করে। এটি এমন একটি অবস্থা যা মৃত্যুকে আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে, তার অনিবার্যতা ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পাকড়াও করার সম্ভাবনাসত্ত্বেও এবং এর স্মরণ ও চিন্তাকে আমাদের কাছে অবাঞ্ছিত ও কঠিন করে তোলে। 

নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুকে আনন্দের ধ্বংসকারী বলে অভিহিত করেছেন, অথচ ভোক্তা পুঁজিবাদ যে মানবসত্তা তৈরি করে তা কিনা আনন্দ-উল্লাসের পেছনে ছোটাকেই চূড়ান্ত প্রচেষ্টা হিসেবে বেছে নেয়। কেননা যদি আমরা মৃত্যুকে বারবার স্মরণ করি, তাহলে আনন্দের এই বাজার চলবে কীভাবে? মৃত্যুর স্মরণ একটি সত্তা তৈরি করে যেটি বেশি মসজিদ-অভিমুখী হয় বাজারের চেয়ে, কারণ এটি অধিক টান অনুভব করে প্রথমটির প্রতি (মসজিদের প্রতি) যা ছাড়িয়ে যায় মৃত্যুকে । এটি এমন একটি সত্তা তৈরি করে যা (ধন-সম্পদ) পুঞ্জীভূত করার বদলে বিলিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেশি অনুভব করে। একজন ব্যক্তি যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন যে কোন বিষয়টি মুমিনকে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান বানায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছিলেন যে যারা মৃত্যুকে প্রায়শই স্মরণ করে এবং তার জন্য সর্বোত্তম প্রস্তুতি নেয় ভাল আমল করার পাশাপাশি তারাই সবচেয়ে জ্ঞানী। 

এবং মারিয়েম মাসমুদি জানিয়েছেন, রমজান, যদি তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ধারায় সংরক্ষিত থাকে এবং অসংযত পেটুকতার মাধ্যমে সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন না করা হয়, তাও সে জীবনের অবনতিকরণ এবং সময়ের যান্ত্রিকীকরণের একটি মূর্ত প্রত্যাখ্যান হয়ে দাঁড়ায় । মাসমুদির মতে, রমজান (ঘড়ির কাটার) ৯টা-৫টা সময়কে ঘিরে আ্মাদের যে অস্তিত্ব গড়ে উঠেছে তার পরিবর্তে প্রাকৃতিক চক্রের সাথে আমাদের জীবনকে ঐকতানিক করার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। নতুন চাঁদ দেখার সাথে সাথে রমজানকে ঘোষণা এবং প্রতিটি ভোরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়ামসাধনার মধ্য দিয়ে আমরা এই সামঞ্জস্য দেখতে পাই । আল্লাহ ইতিমধ্যে পাঁচ সালাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের আদেশ দিয়েছেন, কোনো সালাতের সময়ই যখন তখন বা যেনতেনভাবে নয়, বরং একটি মহাজাগতিক নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত হইয়েছে যা একজন মানুষের বস্তুগত চাহিদা ও তার অতীন্দ্রিয় উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য তৈরি করে।

কাশ্মীরের একজন স্থানীয় হিসাবে, আমিও মনে করি যে রমজান হল আমার জন্মভূমি এবং ফিলিস্তিনের মতো জায়গায় বসবাসকারী মুসলমানদের সাথে আমাদের সংহতির মাত্রা ও তার সারবস্তু পুনর্বিবেচনার সময়। রমজান কুরআনের মাস যা নিপীড়িত - মুস্তাহাধ’আফিনকে বিশেষাধিকার দেয়। কুরআন আমাদেরকে দেখতে বলে জালেমের দৃষ্টি থেকে নয়, মজলুমের প্রিজম থেকে, উপর থেকে নয়, নীচে থেকে । এ ক্ষেত্রে কাশ্মীরের প্রতি মুসলমানদের দ্বৈত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রথম বাধ্যবাধকতা এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে এর লোকেরা মুসলিম। দ্বিতীয়টি হল এই বাধ্যবাধকতা বৃদ্ধি করা তাদের প্রতি চালানো অত্যাচারের কারণে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিতই হোক।" লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি সে নির্যাতিত হয় তাহলে তাকে সাহায্য করা ঠিক, কিন্তু সে যদি অত্যাচারী হয় তাহলে আমরা তাকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "তাকে অন্যের উপর জুলুম করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে।" কাশ্মীরের ক্ষেত্রে, নিপীড়িতরা নিছক নিপীড়িত নয় বরং এটি তাদের মুসলিম পরিচয় যা তাদের নিপীড়নের কারণে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কাশ্মীরি মুসলমান ভারতের কারাগারে তাদের উপবাস ভঙ্গ করবে, এবং আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করি যে নবী যদি আজকে পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তাহলে তিনি কার সাথে উপবাস করবেন? কাশ্মীরের মুসলমানদের সাথে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াতের সাথে পরিচয়ের কারণে কষ্ট পায়? নাকি উপসাগরীয় ভূরি-ভোজে অংশগ্রহণকারীদের সাথে, যারা মোদির মতো মুসলমান-হত্যাকারীদেরকে সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করে? 

 

[লেখক সম্পর্কে: আহমেদ বিন কাসিম ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের একজন লেখক এবং ছাত্র। তিনি বর্তমানে নৃবিজ্ঞানে বিএস করছেন এবং ইসলামে ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজে বিএ করছেন। তিনি কাশ্মীর অঞ্চলের প্রথম পডকাস্টগুলির মধ্যে একটি কোশুর মুসলিম পডকাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও হোস্ট, যেটি বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিকতা, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, তুলনামূলক রাজনৈতিক তত্ত্ব, সমালোচনামূলক ধর্মনিরপেক্ষতা অধ্যয়ন, সমালোচনামূলক মুসলিম অধ্যয়নগুলির মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে।]

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


সম্পাদক নির্বাচিত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কি খিলাফত পতনের যতগুলো কারণ আমরা দেখি তার মধ্যে একটা ছিল ইহুদীদের...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-11-03 21:24:07

ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকারের কট্টরপন্থা কাশ্মীর অঞ্চলটিকে সমৃদ্ধ বা...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-01-22 09:36:01

ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (Institute of Islamic Thought and Re...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-04-04 21:21:54

বিজ্ঞানের ইতিহাস এমন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিপূর্ণ যারা গবেষনার ক্ষেত্রে...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-03-14 19:50:53

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসল...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2022-12-23 22:23:11

প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ছিলেন একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, লেখক, সমাজ চিন্...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-03-29 21:02:52

আজ ১২ আগস্ট, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মৃত্যুবার্ষিকী।  ২০১০ সালের এই দ...

সম্পাদক নির্বাচিত | 2023-08-12 16:28:02