সুদীর্ঘ কাল রাতের পর ফিলিস্তিনিদের দিন আসছে: আবুল আসাদ


বাংলাদেশের অন্যতম প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ ফিলিস্তিন সংকট সম্পর্কে একটি আনুপূর্বিক মূল্যায়ন করেছেন
Published: 2023-11-03 21:24:07 BdST | Updated: 2024-04-29 09:57:39 BdST

গাজা শহর [ফটোগ্রাফার : ইব্রাহীম ফারায]

তুর্কি খিলাফত পতনের যতগুলো কারণ আমরা দেখি তার মধ্যে একটা ছিল ইহুদীদের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র করেছে তারা ভেতর থেকে। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ইহুদীদের কাছে ফিলিস্তিনের জমি বিক্রয় অস্বীকার করায় তিনি তাদের জাতিগত প্রবল প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। নব্য তুর্কিদের মধ্যে এই ইহুদীরা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। ১৯০৯ সালের ২৭শে এপ্রিল নব্য তুর্কিদের পক্ষ থেকে যিনি সুলতানের কাছে তার পদচ্যুতি পত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি একজন ইহুদী। নাম কারাসু। তিনি তুরস্কের একটি ফ্রি ম্যাসন লজ-এর প্রধান (master) ছিলেন। বলা যায়, ইহুদীরা এইভাবেই সুলতান আব্দুল হামিদের উপর প্রতিশোধ নিয়ে বোধ হয় দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাদের বিরোধিতার অর্থ কি? তুর্কি খিলাফত উচ্ছেদে ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা সেদিন কতখানি স্পষ্ট ছিল জানি না, কিন্তু পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকদের কাছে কিছুই গোপন থাকেনি। জানা যাচ্ছে, নব্য তুর্কি আন্দোলন সংগঠনে ইহুদী ফ্রি ম্যাসনের ভূমিকা ছিল খুবই মুখ্য। সিবতেন জেভি নামক একজন নেতৃস্থানীয় ইহুদী ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি এবং তার বিশাল অনুগামীদের ভূমিকা ছিল খুবই সন্দেহপূর্ণ। তাঁর অনুগামীরা নামে মুসলমান হলেও মুসলিম সমাজ থেকে তারা নিজেদের আলাদা করে রাখতো। এই শ্রেণীর লোকেরা শুধু নব্য তুর্কিদের রাজনৈতিক দর্শনই পাল্টায় না, তাদের চরিত্রের সর্বনাশ করে। ঐতিহাসিকদের ভাষায় নব্য তুর্কিরা প্রকাশ্যে ফেজ খুলে ফেলা, মদ্যপান করা, শুকরের গোশত ভক্ষণ করা ও প্রাচীনপন্থী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের রীতিনীতিকে বিদ্রুপ করার কাজে আদৌ কুণ্ঠাবোধ করতো না। 

তুর্কি খিলাফত ঘিরে বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের একটা কঠিন সময়ে সুলতান আবদুল হামিদকে ক্ষমতা থেকে সরান হয়। সরানো হয় কারণ, শত্রুদেরকে তিনি ভালো করে চিনতেন এবং তাদের মুকাবিলায়ও তিনি সমর্থ ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাসের রায় : ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন যেসব যোগ্যতম শাসক, সুলতান আব্দুল হামিদ ছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে তাদেরই একজন (In the Sultan Abdul Hamid Turkey unquestionably possesses one of the ablest rulers who have ever occupied the throne of the Ottoman Empire, - History of the World, XXIV, 433)।

এই বিশাল বৃক্ষকে উৎপাটিত করার পর তাঁর ভাই পঞ্চম মোহাম্মদ, পরে তাঁর আরেক ভাই ওহিদুদ্দীনকে সিংহাসনে বসানো হয়, কিন্তু তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেননি। মাত্র একদশকের মধ্যেই বিশাল তুর্কি খিলাফত বরফের মত গলে শেষ হয়ে যায়। এই সময়েই ফিলিস্তিন এবং জেরুসালেম মুসলমানদের হাতছাড়া হলো।

এই হাতছাড়া হবার কাহিনী বড়ই বেদনাদায়ক। সময়টা ১৯১৮ সাল। উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে গোটা ইউরোপ এবং পূর্বদিকে রাশিয়ার সম্মিলিত আক্রমণ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মেরুদ- তখন ভেঙে দিয়েছে। এই সুযোগে দক্ষিণ দিক থেকে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাহায্যপুষ্ট বৃটেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওসমানীয় স্রামাজ্যের উপর। শহরের পর শহর, প্রদেশের পর প্রদেশের পতন ঘটলো তাদের হাতে। তুর্কিদের শত্রু তখন ঘরে বাইরে। পিছন দিক থেকে কর্নেল লরেন্সের আরব-বিদ্রোহ তাদের বুকে ছুরি মারছিল, আর সামনে থেকে এসে অবশিষ্ট কাজ সমাধা করছিল বৃটিশ বাহিনী। ফিলিস্তিন ফ্রন্টে বৃটিশ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এডম- এলেনবী।

১৯১৭ সালের ৮ই জানুয়ারী ইংরেজরা ফিলিস্তিনের রাফা শহর সর্বপ্রথম দখল করে। আর ১৯১৮ সালের ২৬শে অক্টোবর আলেপ্পো দখলের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ফ্রন্টের যুদ্ধ তারা শেষ করে। তুর্কিবাহিনী ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম রক্ষায় চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। এই দু'বছরের যুদ্ধে এই ফ্রন্টে তাদের ১২ লাখ সৈন্য শহীদ হয়, ৪ লাখ আহত হয় এবং বন্দী ও নিরুদ্দেশ হওয়ার সংখ্যা সোয়া লাখ। এত বড় ত্যাগ স্বীকার করেও তুর্কিবাহিনী জেরুসালেম রক্ষা করতে পারেনি। ১৯১৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর বৃটিশ বাহিনী জেরুসালেমে প্রবেশ করে। পবিত্র নগরী জেরুসালেমের দায়িত্বভার হযরত ওমরের সময় মুসলমানদের হাতে আসার পর ক্রুসেডের শুরুতে ক্ষণিকের জন্য খৃস্টানরা জেরুসালেম দখল করে নেয়। কিন্তু গাজী সালাহউদ্দীন অচিরেই উদ্ধার করেন পবিত্র নগরীকে তাদের হাত থেকে। তারপর গোটা ইউরোপ ৭টি ক্রুসেড পরিচালনা করেছে, কিন্তু জেরুসালেমে আর তারা পা রাখতে পারেনি। অবশেষে সেই জেরুসালেম চলে গেল বৃটিশের হাতে। তারপর ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন সমগ্র আরব, সিরিয়া, মেসপটেমিয়া, কুর্দিস্তান বৃটিশের হাতে গিয়ে পড়ল। 

১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন বৃটিশের হাতে চলে যাওয়ার পরই এখানে ইহুদিদের কালো হাত জেঁকে বসতে থাকে। যুদ্ধে বৃটিশরা ইহুদিদের যে সহযোগতিা পায় তার পুরস্কার হিসেবে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিন তাদের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এই ১৯১৭ সালেই। তদানীন্তন বৃটিশ ফরেন সেক্রেটারী এ.জে. বেলফোর ‘বৃটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের' চেয়ারম্যান লর্ড রথচাইল্ডকে এই মর্মে যে চিঠি (2 Nov-1917)  লিখেছিলেন তার একাংশ এই:

"His majesty's Government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jews people, and will use their best endevour to facilitate the achievement of this object ............"

ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি গড়ে দেবার বৃটিশ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বিশ্ব ইহুদীবাদীদের প্রথম ও প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ফিলিস্তিনের ইহুদীকরণ। এ জন্যে প্রয়োজন ব্যাপক সংখ্যায় ইহুদীদের ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা। এ কাজেই ইহুদীবাদীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগল। ফলে ইহুদী আগমনের হার দ্রুত বেড়ে যায়। ১৮৮২ সাল থেকে বৃটিশ দখল পর্যন্ত ইহুদী আগমনের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার; কিন্তু পরবর্তী মাত্র ১১ বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ইহুদী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৩০ সালের পর ফিলিস্তিনে ইহুদী আগমন আরও দ্রুত হয়। ১৯৩১ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭০ হাজার ইহুদী ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করে।

এ প্রসঙ্গে হিটলারের জার্মানীতে ইহুদী নির্যাতনের বিষয় আলোচনা করতে হয়। আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, হিটলারের ইহুদী নির্যাতনের সাথে ইহুদীবাদীদের যোগসাজশ ছিল; যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে ব্যাপক মাইগ্রেশনে ইহুদীদের বাধ্য করা এবং সেই সাথে বিশ্বব্যাপী ইহুদীদের জন্য সহানুভূতি অর্জন করা যা ইহুদী আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কথাটা অনেকের কাছেই নতুন মনে হবে। কিন্তু ইহুদীবাদীদের ইহুদীবাদকে যারা জানেন তাদের কাছে ব্যাপারটা মোটেই নতুন মনে হয় হবে না। ইহুদীবাদের চেহারা এমনই হিংস্র যার কোন তুলনা নেই। 

ইহুদীদের উপর এই নাজী নির্যাতনের অনেক আগে ইহুদীবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিয়োডর হারজেল বলেছিলেন, “এ্যান্টি সেমেটিকরা আমাদের বন্ধু হবে। এ্যান্টি সেমেটিক দেশগুলো হবে আমাদের মিত্র।” (Herzls vol. 1 P-84) ইহুদীবাদীদের তত্ত্বটা এই রকমঃ এ্যান্টি সেমেটিকদের ভয়ংকর মুখটা যেখানেই তুমি দেখ, তাদের বিরুদ্ধে যেয়ো না। বরং তাদের সহযোগী হও তাদের ব্যবহার কর যাতে করে পিতৃভূমি ইসরাইলে ইহুদীদের হিজরত করানো যায়।” এই তত্ত্ব অনুসারেই ইসরাইল রাষ্ট্রের স্রষ্টা ইহুদীবাদীরা শুরু থেকেই কঠোর এ্যান্টিসেমেটিক হিটলারের নাজি দলকে সহযোগিতা করে এসেছে। এবং তারাও নাজীদের কাছে সহযোগিতা পেয়েছে। ‘I Paid Hitler’ বইতে Thyssen বিস্তারিতভাবেই বলেছেন, ‘জার্মানী ও আমেরিকার ইহুদী ব্যাংকগুলো ইহুদীবাদীদের কথায় হিটলারকে দু'হাতে টাকা দিয়ে পোষণ করেছে। জার্মানীতে নাজীরা ক্ষমতাসীন হবার পর জার্মানীতে ইহুদীদের বিরাট সুদিন আসে। ইহুদীবাদী সংগঠনগুলো ১৯৩৫-৩৬ সালে নাজী সরকারের কাছ থেকে ১৯৩১ সালের অ-নাজী শাসনের তুলনায় তিনগুণ বেশী সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করে। ইহুদীবাদী সাপ্তাহিক 'Jüdische Rundschau'-এর প্রচার সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ৪০ হাজারে উন্নীত হয়। জার্মানীর ইহুদীরা হিটলার কর্তৃক আরোপিত যে স্বতন্ত্র ধরনের হলদে পোশাক পরতে বাধ্য হয় তার প্রস্তাবক ছিলেন ইহুদীবাদী এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক। তিনিই প্রথম এই আইডিয়ার উদ্ভাবন করেন এবং একে এই জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিণত করেনঃ Wear it with pride, the yellow star. ইহুদীবাদী সাপ্তাহিক এই শ্লোগান তোলার ৬ বছর পর নাজীরা ইহুদীদের জন্য এই পোষাকের প্রবর্তন করে। হিটলার ইহুদীদের চাহিদা অনুযায়ী একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই আগ্রহী ছিলেন। থিয়োডর হারজেল প্রস্তাবিত মাদাগাস্কারে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইহুদীবাদীদের সাথে আলোচনার জন্য জার্মানীর ঊর্ধ্বতন নাজী রাজনীতিক Dr. H. Jalman Schacht কে হিটলার ১৯৩৮ সালে লন্ডন পাঠান।

আবার ইহুদীবাদী নেতারাও হিটলারের সাথে এই আলোচনায় জড়িত ছিলেন। (Protocols of the Israeli Knesset of 30-6-57) জার্মানী, হাংগেরী, অষ্ট্রিয়া সব জায়গাতেই নাজীদের সাথে ইহুদীবাদীদের সহযোগিতার একটা মজবুত ক্ষেত্র ছিল। নাজীরা ইসরাইলে গমণেচ্ছু ইহুদী যুবকদের এমন কি কৃষি ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করে তোলারও ব্যবস্থা করে। দু'জন বৃটিশ ইহুদীবাদীর লিখা বিখ্যাত বই ‘The Secret Road'-এ এর বহুল স্বীকৃতি রয়েছে। এ বইতে বলা হয়েছে, কেমন করে দু'জন ইহুদী তরুণ ১৯৩৮ সালে বার্লিন ও ভিয়েনায় গেল, কেমন করে জার্মান গেষ্টাপো প্রধান আইখম্যানের কাছে ইসরাইলের ইহুদীদের স্থানান্তর পরিকল্পনা পেশ করা হলো এবং কিভাবে আইখম্যান ইহুদীদের প্রস্তাব গ্রহণ করে ইসরাইল গমণেচ্ছু ইহুদী তরুণদের জন্য ট্রেনিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠা করলেন, ইত্যাদি। আইখম্যানের নির্দেশেই ইহুদীবাদী কর্মীরা ইহুদী যুবক সংগ্রহ করার জন্য গোটা জার্মানী এবং ইহুদী ক্যাম্পগুলোতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতো। ইসরাইলে পাঠাবার জন্যই এসব যুবক সংগৃহীত হতো। ১৯৪৪ সালেও আইখম্যান হাংগেরীতে ইহুদী নেতা Dr. Rudolf Kastner-কে হাজার হাজার ইহুদীবাদী যুবককে ইসরাইলে পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করে। বিনিময়ে Dr. Kastner আইখম্যানকে অ-ইহুদীবাদী ইহুদীদের কাবু করার ব্যাপারে সহায়তা করেন। ইসরাইলী আদালতেও এই যোগসাজশের বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। ইসরাইলী আদালত এ সম্পর্কিত এক রায় দান করে। 

সবদিকের বিচারে ইহুদীবাদীরা তাদের তত্ত্ব অনুসারে জার্মানীতে এ্যান্টিসেমিটিক মনোভাব উদ্দীপ্ত করে এবং একে ব্যবহারের মাধ্যমে অগণিত নিরপরাধ অ-ইহুদীবাদী ইহুদীদের রক্তের বিনিময়ে ইউরোপ আমেরিকার সমর্থন আদায় এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন সম্পন্ন করে। এই যে  লাভ তারা করল তার তুলনায় কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ ইহুদীর কোরবানী তাদের কাছে কিছুই নয়। ইসরাইলের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার একজন সম্পাদকের একটা খেদোক্তি এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেনঃ আমি যা চাই সে ক্ষমতা যদি আমার থাকতো তাহলে কুড়ি কুড়ি বুদ্ধিমান ও জাতীয় আদর্শে নিবেদিত ইহুদী যুবককে দেশে দেশে পাঠাতাম যেখানে ইহুদীরা সুখের জীবন যাপন করছে। সেখানে গিয়ে তারা প্রবল ইহুদী বিরোধী মানসিকতা সৃষ্টি করতো যাতে শ্লোগান উঠতো, শয়তান ইহুদী তোরা ইসরাইলে চলে যা, ভীত সন্ত্রস্ত ইহুদীরা তখন ইসরাইলের পথ ধরতো।

সন্দেহ নেই জার্মানীতে ইহুদী হত্যা ইহুদীবাদীদের এই উদ্দেশ্যই চরিতার্থ করেছে। জার্মানীর ইহুদী হত্যা ছিল ইহুদীবাদীদের বহু আকাংখিত এক উৎসব। এই সময় থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদী আগমনের হিড়িক পড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত ইহুদী আগমনের হিসেব আগেই দিয়েছি। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলো, তখন বিশ্বের দেশে দেশে ইহুদীদের খেদিয়ে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার ইহুদীবাদী অভিযান আরও তীব্রতর হয়। এর ফলেই আমরা দেখি ১৯৪৮ সালের মে থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়ে সোয়া পাঁচ লাখ ইহুদী ফিলিস্তিনে আসে। পরবর্তী দুই দশকে (১৯৭০ পর্যন্ত) ইহুদীবাদীরা আরো সাড়ে আট লাখ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে ধরে আনে। এই কাজ তাদের এখনো চলছে।

এইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে একটা জাতির লোক কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে ধরে ধরে এনে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মত টেষ্টটিউব বেবী ধরনের পন্থায় অবৈধ ও কৃত্রিম একটা রাষ্ট্র অবশেষে কিভাবে জন্মদান করা হল সেদিকে নজর দেয়া যাক। আগেই বলেছি, ১৯১৭ সালে বৃটেন ফিলিস্তিনে তুর্কী সৈন্যদের পরাজিত করে ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ‘মহাযুদ্ধের পর আরবদের স্বাধীনতা দেয়া হবে'  এ প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে আরব বিদ্রোহীরা তুর্কীদের বিরুদ্ধে বৃটেনকে সাহায্য করে। কিন্তু ফিলিস্তিন দখল করার পর কিভাবে বৃটেনের প্রতিশ্রুতি পাল্টে যায়, ব্যালফোরের ঘোষণা থেকে তা আগেই জানা গেছে। ব্যালফোরের এ ঘোষণাকে লয়েড জর্জ ইহুদীদের জন্য বৃটেনের একটি পুরস্কার বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে ইহুদীবাদীরাও বৃটেনের জন্য পুরস্কারের একটা মূলো সামনে রেখেছিল। আন্তর্জাতিক ইহুদী কংগ্রেসের সভাপতি নাহুম গোল্ডম্যান সে সময় ঘোষণা করেছিলেন, ‘বৃটেন যদি ফিলিস্তিনীদের শতকরা ৬৫ ভাগ এলাকায় আমাদের জন্য একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয় তাহলে আমরা ফিলিস্তিনে বৃটেনের নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর জন্য ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ করে দিতে রাজি আছি। মার্কিন কংগ্রেসও ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন সরকারের কাছে এ আবেদন জানাল যে, তারা যেন ফিলিস্তিনে অবাধ ইহুদী গমন এবং সেখানে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন। বুদ্ধিমান বৃটেন ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে না নিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে এটা সম্পন্ন করার জন্য ফিলিস্তিন প্রশ্ন জাতিসংঘে উত্থাপন করে। জাতিসংঘে অনেক বাহাস-বিতর্ক হয় এ নিয়ে। অবশেষে ইহুদী প্রভাবিত বৃটেন, মার্কিন ও রুশদের চাপের মুখে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের তৃতীয় সাধারণ অধিবেশনে তার ১৮১ নং প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের মোট আয়তনের ৫৬ ভাগ এলাকায় একটি ইহুদী রাষ্ট্র এবং অবশিষ্ট এলাকায় একটি আরব রাষ্ট্র গঠন করার আহ্বান জানায়। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের শতকরা ৮ ভাগ ইহুদী (যাদের পনর আনাই বহিরাগত) পেল ৫৬ ভাগ এলাকা এবং শতকরা ৯২ ভাগ মুসলিম বাসিন্দা পেল ৪৪ ভাগ এলাকা। এই ঐতিহাসিক অবিচার কর্ম জাতিসংঘে ভোটাভুটি নামক শক্তিমানদের প্রহসনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ তেত্রিশটি দেশ ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষে ভোট দেয়। মাত্র তেরটি দেশ এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। জার্মানীর ইহুদী নির্যাতনকে পুঁজি করে এবং ইহুদী অর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তির জেরে জাতিসংঘে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট কুড়ানো সম্ভব হয়। এইভাবে ১৮৯৭ সালের থিয়োডর পরিকল্পনা ১৯১৭ সালের ব্যালফোর ঘোষণা এবং ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ প্রস্তাবের আশীর্বাদ শিরে নিয়ে ফিলিস্তিন ত্যাগকারী বৃটিশ সৈন্যদের অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইহুদীরা ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দান করে। অত্যন্ত বেদনার বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বৃটেনসহ পৃথিবীর তেত্রিশটি দেশ হিটলারের ইহুদী নির্যাতনের ভূখোড় সমালোচক হয়েও হিটলারের চেয়ে অনেক বড় অপরাধ তারা করলো। এদিকটির প্রতি অংগুলি সংকেত করতে গিয়েই জর্জ এ্যাসটোনিয়াস ১৯৩৮ সালে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেনঃ "To place the brunt of the burden upon Arab Palestine is a miserable evasion of the duty that lies upon the whole of the civilised world --- No code of morals can justify the persecution of the one people in an attempt to relieve the persecution of another. The cure for the eviction of the jews from Germany is not to be sought in the eviction of the Arabs from their homland; and the relief of jews destress may not be accomplished at the cost of intflicting a corresponding distress upon an innocent and peaceful population" (The Arabs, page 331)

রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে ইসরাইলের ইহুদীরা ফিলিস্তিনী মুসলিম বাসিন্দাদের হত্যা, লুণ্ঠন ও উচ্ছেদের কাজ শুরু করে দেয়। লাখ লাখ মানুষ সব কিছু হারিয়ে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। উপায়ন্তর না দেখে আরব দেশসমূহ ফিলিস্তিনীদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। আরবরা যে এভাবে এগিয়ে আসবে তা ইহুদীরা জানতো। এজন্য তারা বহু বছর থেকে নিজেদের প্রস্তুত করে তুলেছিল অস্ত্র ও ট্রেনিং দুই দিক থেকেই। তাই দেখা গেল গ্রান্ড মুফতি আমিন আল-হুসায়নী ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বেচ্ছাসেবকসহ পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলো যে বাহিনী ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিয়ে এল তার সংখ্যা ৫৬ হাজারের বেশী নয়, আর ইহুদীরা এর মোকাবিলায় ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্য মাঠে নামালো। এরপরও সাফল্য আরবদের পক্ষেই এলো। জর্দান বাহিনী জেরুসালেমসহ পূর্ব ফিলিস্তিন মুক্ত করলো ইরাক বাহিনী তড়িৎগতিতে এগিয়ে ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবের তিন মাইলের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হলো। অন্যদিকে মিসরীয় সৈন্যরা বীরশিবা ও গাজার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বসলো। নব্য ইসরাইল রাষ্ট্রের যখন এই মুর্মূর্ষু দশা তখন তার মুরব্বীদের চাপে জাতিসংঘের মাধ্যমে আপোস ফায়সালার স্বার্থে ৪ সপ্তাহের জন্য যুদ্ধ বিরতি হয়। এই যুদ্ধ বিরতি ছিল মূলতঃ ইসরাইলকে অধিকতর প্রস্তুতির সুযোগ দেয়া এবং আরবদের মধ্যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের সুবিধা করার জন্যই। তাই হলো। জাতিসংঘ আরব কিংবা ইহুদী কোন পক্ষকে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের এই নির্দেশ উপেক্ষা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চেকোশ্লাভাকিয়া গোপনে ইসরাইলকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান সরবরাহ করল (The Arab's by Anthony Nutting, Pages, 327, 328)। আরবরা মনে করছিল, আর এক ধাক্কা দিলেই ইসরাইল শেষ হয়ে যাবে কিন্তু রাশিয়া থেকে গোপন অস্ত্র সরবরাহের খবর তারা জানত না। ফলে যুদ্ধ যখন শুরু হলো, আরবদের অগ্রগতি তখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। পুনরায় যুদ্ধ বিরতি হলো জুলাইয়ের ১৮ তারিখে। ইসরাইল সোভিয়েত ব্লক থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান আনার আরেকটা সুযোগ পেয়ে গেল। অন্যদিকে আরবদের অস্ত্রের উৎস ছিল পশ্চিমী দেশগুলো যারা জাতিসংঘের প্রতি ‘অপরিসীম আনুগত্য' দেখিয়ে আরবদেরকে একটি বুলেটও সাহায্য দিল না। উপরন্তু আরবদের মাঝে ভুল বুঝা-বুঝি সৃষ্টি এবং অনেকের সাথে আঁতাত গড়ে তোলার ষড়যন্ত্রের পথ তারা অনুসরণ করল। সুতরাং নতুন করে যখন যুদ্ধ শুরু হলো, আরবদের মাঝে দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা গেল। জর্দান নিষ্ক্রিয় ভূমিকা অবলম্বন করল। মিসর বীরশিবা থেকে পিছু হটে শুধু গাজা অঞ্চল আঁকড়ে ধরে থাকার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ করল। ইরাকী বাহিনী একা পড়ে যাওয়ায় তাকে পিছু হটতে বাধ্য হতে হলো। এইভাবে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর অঞ্চল ও গাজা এলাকা ছাড়া ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অংশ ইসরাইল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলো।

ইসরাইলের এই ‘মিরাকল' বিজয়ের একটা বড় কারণ ছিল নবজাত ইসরাইল রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা। ইসরাইলের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান ছিলেন একজন রুশ ইহুদী। সম্ভবতঃ এই কারণেই ইসরাইল রাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়ন একান্তই নিজের বলে জ্ঞান করেছিল। অবশ্য ফিলিস্তীনে ইহুদী ষড়যন্ত্রের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক আগে থেকেই যুক্ত। মস্কো ১৯২০ সালে প্রখ্যাত গেরিলা নেতা ভলাদিমি গ্রাবটস্কিকে (ইনি পিটার্সবার্গ দখলের অভিযানে কমিউনিস্ট সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছিলেন) ফিলিস্তিনে পাঠায় ইহুদী যুবকদের ট্রেনিং-এর দায়িত্ব দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। ইহুদীদের প্রাপ্ত অর্থের শতকরা ৪০ ভাগেরই যোগানদার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকা শতকরা ১৯, পশ্চিম ইউরোপ ১৬ এবং পূর্ব ইউরোপ ২১ ভাগ অর্থের যোগান দেয়। এই হিসেবে কমিউনিস্টরা ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্য শতকরা ৬১ ভাগ অর্থ সরবরাহ করে। এছাড়া মস্কো প্রেরিত প্রতিনিধি দল কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফিলিস্তিনে রুশ ইহুদীদের জন্য জমি কেনে।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়ের এবং যুক্তির বিরুদ্ধে শক্তির যে বিজয় সূচিত হয়েছে, তার আর নিরসন হয়নি বরং তা আরও শিকড় গেড়েই বসেছে। ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধে ইসরাইল তার ঐ মিরাকল শক্তি দিয়ে মিসরের গাজা ও সিনাই অঞ্চল জর্দানের জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও জেরুসালেম এবং সিরিয়ার গোলান হাইট দখল করে নেয়। ইসরাইলের প্রতি আমেরিকাসহ পশ্চিমী শক্তির সহযোগিতা এবং আরবদের পিছনে দাঁড়ানো সোভিয়েত ইউনিয়নের মীরজাফরী ভূমিকার ফলেই এ মজার ‘মিরাকল' সম্ভব হয়। মজার বলছি একারণে যে মিসর ও সিরিয়া- এ দু'জনেরই সে সময় যে শক্তি ছিল তা দিয়ে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কয়েক ঘণ্টায় মুছে ফেলা সম্ভব ছিল, কিন্তু তা হয়নি। কারণ রুশরা তাদেরকে অস্ত্র দিয়েছিল টাকা কামাই ও বন্ধু সেজে রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যই- ইসরাইলের কোন ক্ষতি করার জন্য নয়। তাই তো দেখা গেল, ১৯৭৩ সালে মিসর বাহিনী একাই তাদের এক দুর্ধর্ষ অভিযানে ইসরাইলের তৈরী তার অহংকার এবং অজেয় বলে কথিত বারলেভ প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে যখন বিদ্যুৎ গতিতে ইসরাইল অভিমুখে অগ্রসর হলো এবং ইসরাইলের পতন ঠেকানোর জন্য যখন ওয়াশিংটন তেল আবিবের মধ্যে সাহায্যের বিধান সেতু রচিত হলো তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু মিসরের দিক থেকে তার সাহায্যের হাতেই টেনে নিল না বরং চাপ দিল তাকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য।

কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনীদের উপরকৃত অন্যায়কে পাকাপোক্ত করা এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে সবদিক থেকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য ইসরাইলের ঐ বন্ধুরা রীতিমত কূটনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। রেজাল্ট এইঃ সম্মুখ সমরে জেতা যাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, কূটনৈতিক যুদ্ধেও তারাই মার খাচ্ছেন। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং তার সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিসর অবমাননাকরভাবে ইসরাইলের কাছ থেকে তার হারানো এলাকা ফিরে পেয়েছে। দক্ষিণ সীমান্তে আগের সেই উদ্বেগ অনিশ্চয়তা ইসরাইলের নেই। পূর্বদিকে জর্দান সীমান্তের অবস্থাও কতকটা এ রকমেরই। জর্দান আর জর্দান নদীর পশ্চিমতীর দাবি করছে না এবং এ ধরনের কোন সমস্যা নিয়ে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে নামার সামান্য কোন ইচ্ছাও মনে হচ্ছে জর্দানের নেই। ফিলিস্তিনীদের এই এলাকা সে ফিলিস্তিনের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছে। সিরিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে হৈচৈ করছে ঠিকই কিন্তু সমস্যার গভীরে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় গোলান হাইটস নিয়ে সিরিয়ার কোন দুশ্চিন্তাই নেই। আজ চার যুগের বেশি গোলান হাইটস ইসরাইলের দখলে। ইসরাইলকে তার অবৈধ দখল থেকে সরাবার কোন কার্যকরী ব্যবস্থাই সিরিয়া করেনি। উপরন্তু লেবাননে সিরীয় বাহিনীর যে ভূমিকা আমরা ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে ইসরাইলী বাহিনীর দক্ষিণ লেবানন আক্রমণ, দখল ও গণহত্যা চালানোর সময় দেখেছি, সেটা জাতিগতপ্রাণ কোন যোদ্ধার ভূমিকা নয়। সবদিক থেকে তাই মনে হয়। সিরিয়া সরকার লোক দেখানোভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হৈচৈ করলেও তার সাথে কোন যুদ্ধে নামার ইচ্ছা তার মোটেই নেই। মনে হয়, তলে তলে সে আরেক ক্যাম্প ডেভিডের জন্য রাজি এবং এরই দর কষাকষির একটা উপায় হিসেবে সে নিজেকে লেবানন সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল যাতে ইসরাইল ও ইসরাইলের মুরুব্বীদের প্রয়োজন তাকে হয়। কিন্তু লেবানন থেকে বিতাড়িত হবার পর সে আশায় গুড়ে বালি হয়েছে এরপর বাকি থাকে লেবানন রাষ্ট্র। আমরা জানি, লেবানন আজ নিজেই বিপন্ন সুতরাং ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার তার কোনই ক্ষমতা নেই। দক্ষিণ লেবাননে ফিলিস্তিনীদের শূন্যস্থানে কার্যরত হেজবুল্লাহই কার্যত দক্ষিণ লেবাননের রক্ষাকর্তা।

এ অবস্থায় ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তনীদের ভূমিকাই শুধু অবশিষ্ট থাকছে। ইসরাইল সীমান্তের আরব-রাষ্ট্রগুলোকে কূটনৈতিক পথে যেভাবে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দাঁড় করানো হচ্ছে, ফিলিস্তিনীদের ক্ষেত্রেও এ চেষ্টা করা হয়েছে। ক্যাম্পডেভিড চুক্তিতে ফিলিস্তিনীদের ‘স্ব-শাসন' প্রতিষ্ঠার একটা ফর্মুলা দিল। পরে রিগ্যানও একটা ‘শান্তি পরিকল্পনা' পেশ করেন। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পিএলও স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বদলে ‘স্ব-শাসন' বা ‘স্বায়ত্তশাসন'-এর কভারে ইহুদী আধিপত্যবাদী অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি হয়নি। এরপরই পিএলও এর উপর নেমে এলো দুর্যোগ। ইসরাইল সীমান্তে পিএলও'র শেষ সামরিক অবস্থান লেবাননে মার্কিনী মদদপুষ্ট ইসরাইল পিএলওকে কচুকাটা করল এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করল লেবানন থেকে। মৌনব্রত পালন করে সিরিয়া শুধু ইসরাইলকে সহযোগিতাই করল না, উত্তর লেবাননে পিএলও'র অবশিষ্ট শক্তিকে সে বিধ্বস্ত করল। এভাবে ইসরাইল এবং সিরিয়া পিএলওকে এমন অবস্থায় নিয়ে পৌঁছাল যার ফলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সামরিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া তার পক্ষে আজ কঠিন। সুতরাং অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, ইসরাইলের চার সীমান্ত নিরাপদ। হেজবুল্লাহ ও হামাসের ক্ষুদ্র শক্তিই শুধু রয়েছে উল্লেখ করার মত। এ পর্যন্ত এক্ষেত্রে ইসরাইলের যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল তা আজ প্রায় অন্তর্হিত।

 এই অবস্থাতেই ইয়াসির আরাফাতের পিএলও-আলফাতাহ-ক্যাম্পডেভিড ধরনের অধীনতামূলক মিত্রতা মেনে নেয়। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। মূল সমস্যার সমাধান না হলে সমস্যা মিটতে পারে না। ইহুদীরা অন্যায়ভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসে দেশের মালিক সাজার বিহিত এখনো হয়নি, বিহিত হয়নি যে লাখ লাখ বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করেছে তার। এই উদ্বাস্তুরা উদ্বাস্তুই থাকবে তাদের জায়গা জমি সম্পদ ফিরে পাবে না, অথচ তাদের অধিকার মাড়িয়ে একটা স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে এবং অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্রটি অতঃপর নাকে তেল দিয়ে আরামে ঘুমাবে তা কিছুতেই বৈধ নয়। ইসরাইলী ইহুদীরা জেরুসালেমকে রাজধানী ঘোষণা করেছে এবং সে রাজধানী এখন পুরোপুরি কাজ করছে। এখান থেকেও তার নড়ার কোন লক্ষণ নেই। এগুলোর দিক থেকে চোখ বন্ধ রেখে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ও গাজা এলাকায় একটা ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র কায়েম হতে পারে। কিন্তু ঐ এলাকায় সত্যিকার শান্তির কোন পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে না। হতে পারে না কারণ ইতিহাসের শুরুতো ১৯৬৭ সাল থেকে নয়। কমপক্ষে ১৯৪৮ সাল থেকে হিসেব করতে হয় এই ইতিহাসের বয়স। আগের এই ইতিহাসকে মুছে ফেলা যাবে না এটাই বাস্তবতা।

কিন্তু কারও দৃষ্টিই এই বাস্তবতার দিকে নেই। মনে পড়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে মার্কিন এক কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, আলোচনার মিছিল আর জটিল সব রোডম্যাপের চাইতে আপনারা একটা কাজ করুন না। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনের যে এলাকা দখল করেছ, সেটা নিঃশর্তভাবে ফিলিস্তিনীদের ছেড়ে দিন। তারপর দেখুন কি ঘটে। সমস্যা সমাধানের এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। মার্কিন কর্মকর্তাটি উত্তরে বলেছিলেন, সমস্যাটা এ রকম সহজ নয়। ঐ সফরে ইহুদী সংস্থার একজন কর্মকর্তার সাথেও একটা সাক্ষাৎকার ছিল। তাকেও এই কথাই বলেছিলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার, তার জবাব মার্কিন কর্মকর্তার জবাবের কার্বন কপি ছিল। আসলে ইসরাইল, তার সহগামী কতিপয় পশ্চিমী শক্তি এবং জাতিসংঘ সমস্যার মূল দূর করতে চায় না। তারা চায় মূল সমস্যা জিইয়ে রেখে তাকে কেন্দ্র করে সংকট সৃষ্টি করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনী ও প্রতিবেশী আরবদের উপর চড়াও হতে। এর লক্ষ্য দুটি। এক. ইসরাইলের জন্যে পশ্চিমী মোটা সাহায্য অব্যাহত রাখা এবং দুই. ফিলিস্তিনীদের সংকটের পর সংকটে ফেলে দুর্বল ও বশংবদে পরিণত করা। এ পর্যন্ত ইসরাইলীরা কৌশলগত এই দুই লক্ষই অর্জন করে এসেছে। ইসরাইলের সংকট ও নিরাপত্তার অজুহাতে পশ্চিম থেকে অঢেল অর্থ ও অস্ত্র আসছে ইসরাইলে। এই অর্থ ও অস্ত্রে নিজেকে সে অজেয় একটি সামরিক শক্তিতে পরিণত করছে এবং তার নিরাপত্তার জন্য যাকেই হুমকি বলে মনে করছে তাকেই উৎখাত করা ইসরাইলের জন্যে বৈধ বলে পশ্চিমীরা রায় দিচ্ছে। এইভাবেই ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থা পিএলওকে জর্দান থেকে ও লেবানন থেকে উৎখাত করে দুর্বল করে ফেলা হয় এবং তার ফলেই মার্কিন মধ্যস্থতায় ক্যাম্প ডেভিডের আদলে পিএলও দিয়ে ইসরাইলের সাথে আধনতামূলক মিঞা চুক্তি স্বাক্ষর করা এবং ইসরাইলের প্রতি তাদের স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়। এই চুক্তির দ্বারা ফিলিস্তিনীরাএমন এক লজ্জাজনক স্বশাসন (self rule) পেয়েছে, যখন ইসরাইলী পুলিশ ফিলিস্তিনী মন্ত্রীদের ধরে নিয়ে যেতে পারে এবং ইয়াসির আরাফাতের মত সম্মানিত নেতা ও ফিলিস্তিনীদের প্রেসিডেন্টকে মাসের পর মাস গৃহবন্দী করে রাখতে পারে। ফিলিস্তিনী স্বাধীনতা সংগ্রামী সংস্থা পিএলও-এর মতো ইসরাইলের হাতের মুঠোয় আসতে চায়নি বলে হামাসকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তাদের সরকারকে শান্তিতে কাজ করতে দেয়া হয় না। 

কিন্তু দিন কারো সমান যায় না। ফিলিস্তিনিদেরও যাবে না। ইসরাইলের দারোগাগিরী চিরদিন চলবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বল হলো জনবল। আর জনবল সব সময় ন্যায়ের পক্ষেই থাকে। ইউরোপ আমেরিকার যে জনবলকে ইসরাইল প্রচারের জোরে হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে, সে জনবল এখন সচেতন হচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের সাম্প্রতিক ধ্বংসলীলা পাশ্চাত্যের মানুষকেও কষ্ট দিয়েছে। এই জন্যেই মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালীসহ বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের পক্ষে ব্যাপক জনসমাগম দেখা যাচ্ছে। এমনকি জায়নবাদ বিরোধী ইহুদীরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠান করছে। এমনটি আগে কখনও দেখা যায়নি। 

আসলে হামাস একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটিয়েছে। আত্মরক্ষার দীর্ঘ এক অধ্যায়ের পর হামাস প্রথমবারের মত ইসরাইলে আক্রমণ পরিচালনা করল। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের সাউদার্ন কমান্ডের বড় অংশকে পরাভূত করে ইসরাইলের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়। ক্যাপ্টেন থেকে জেনারেল পর্যায়ের কিছু সেনা অফিসারকে হামাস বন্দী করেছে। বন্দী করেছে কয়েকশত ইসরাইলীকেও। ইসরাইলের পৃথিবী শ্রেষ্ঠ পাহারাদারী ব্যবস্থাকেও হামাস কাঁচকলা দেখিয়েছে। ইসরাইল তার দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী, তার অভেদ্য পাহারাদারী ব্যবস্থা এবং তার নিঃশ্চিদ্র সীমান্তের জন্য দুনিয়াব্যাপী যে নাম কুড়িয়েছিল, তার সেই ইমেজ একদম ধ্বসে পড়েছে। লজ্জা ঢাকার জন্যে, দুর্বলতা ঢাকার জন্যে ইসরাইল আকাশ পথে গাজার উপর অব্যাহতভাবে বোমা বর্ষন করে চলেছে। এতে হাজার হাজার গাজাবাসি ফিলিস্তিনি নিহত-আহত হচ্ছে বটে, কিন্তু এতে ইসরাইলের হারানো ইমেজ একটুও উদ্ধার হচ্ছে না। খোদ ইসরাইলী জনগণের একাংশ থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়ার মানুষ ইসরাইলের নিন্দা করছে, ভর্ৎসনা করছে। রাষ্ট্র-সন্ত্রাসী বলে গালি দিচ্ছে এবং যুদ্ধাপরাধের দায় তার ঘাড়ে চাপাচ্ছে।

ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে ফিলিস্তিনিদের এই সফল অভিযান এবং পৃথিবীব্যাপি ইসরাইলের গণহত্যা ও আগ্রাসী নীতির সমালোচনার ঘটনা ফেলে আসা অতীতের বিপরীত। মনে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের এক নতুন পৃথিবী জাগছে। নিশ্চয় সে পৃথিবী অত্যাচারী, সেচ্ছাচারী ও আগ্রাসী ইসরাইলীদের হবে না, সে পৃথিবী হবে হামাসদের। ফিলিস্তিনিদের দিন আসছে। 

 


লেখক: আবুল আসাদ

প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03