যেভাবে মুসলিম বিশ্বে একটি গ্লোবাল মার্কেট তৈরি করা যায়


ইহসান ফিত্রী
Published: 2023-06-13 23:28:54 BdST | Updated: 2024-05-14 08:53:19 BdST

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর হিসাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। কারণ এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ব্যাহত করেছে এবং অনেক দেশে অর্থনৈতিক সংকোচনের পূর্বাভাস দিয়েছে। এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশ্বিক সংকটের কথা বুঝাচ্ছে। এতে অনেক মুসলিম দেশই সংকটে পড়বে। সেজন্য, মুসলিম দেশগুলোর নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি। অন্যান্য পক্ষ সমূহের উপর নির্ভরশীল না হয়ে খাদ্য ও জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষমতা তৈরি করা মুসলিম দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ঘাতসহতা এবং প্রতিরক্ষার স্তম্ভ এবং সেইসাথে অন্যান্য খাতে উন্নয়নেরও স্তম্ভ।

একটি দেশের খাদ্য ও জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জনে অক্ষমতা সেই দেশের দুর্বলতার একটি রূপ। অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা স্থিতিস্থাপকতা এবং তার নিরাপত্তা ব্যাহত করে। তাই যে দেশ শক্তিশালী হতে চায় সে দেশের জন্য খাদ্য ও জ্বালানি আমদানি বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জ্বালানি এবং খাদ্য স্বাধীনতার সূচনা করার চেষ্টা করার সময় তাদের নিজস্ব ক্ষমতা পরিমাপ করা মুসলিমদের জন্য খুব জরুরী।

স্বাভাবিকভাবেই, মুসলিম দেশগুলি ধনী দেশ এবং পর্যাপ্ত জ্বালানি ও খাদ্যের মওজুদ রয়েছে। সমস্ত মুসলিম দেশের তেলের মোট মজুদ (প্রমাণিত তেলের মজুদ) রয়েছে ৯৯৮ বিলিয়ন ব্যারেল। ২০১৯ সালে মোট অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হয় এক বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ব্যারেল। ২০২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এই উৎপাদন কমে যায় এবং বিশ্বে ব্যবহার কমে যায়। মুসলিম দেশ সমূহের মধ্যে বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ হল সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। মোট গ্যাসের মজুদ ১১৭ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। বার্ষিক উৎপাদন ১.৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার, বা ৮.৮ বিলিয়ন ব্যারেলের সমতুল্য। বর্তমানে, প্রায় এর অর্ধেক তেল ও গ্যাস বা প্রায় ২০.৮ বিলিয়ন ব্যারেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনে রপ্তানি করা হয়। মুসলিম দেশগুলিতে মোট জ্বালানি খরচ প্রতি বছর ১০.৪ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের সমান।

খাদ্যের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন বছরে ৪২৫ মিলিয়ন টন। সমস্যা হলো, এসব শস্যের অনেকাংশ উন্নত দেশে রপ্তানি করা হয় কারণ অনেক শস্য ক্ষেত্র বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে।

মাংস উৎপাদন আনুমানিক ৩৬.৮ মিলিয়ন টন। তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও মিশর সবচেয়ে বেশি মাংস উৎপাদনকারী মুসলিম দেশ। যদি এটা মুসলিম দেশসমূহের জনসংখ্যার মাঝে ভাগ করা হয়, তাহলে প্রতি বছর প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতি ২১ কেজি মাংস বা প্রতিদিন জনপ্রতি ৫৮ গ্রাম মাংস পাবে। এটি দৈনিক পুষ্টির চাহিদার তুলনায় একটি ছোট সংখ্যা। তবে, মুসলিম দেশগুলিতে মাংসের আরো কিছু উৎস রয়েছে, যেমন মাছ, মুরগি, এছাড়া রয়েছে মাংসের বিকল্প উদ্ভিজ্জ প্রোটিন।  

এই বাস্তবতার ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বের জ্বালানি ও খাদ্যের ক্ষেত্রে অন্য দেশের উপর নির্ভরতার প্রয়োজন নেই। এবং দারিদ্র্যতা, তীব্র ক্ষুধা বা অপুষ্টির ঘটনা মুসলিম দেশগুলিতে হওয়া উচিত নয়। মুসলিম বিশ্বের জন্য বিশ্বব্যাপী বাজার গড়ে তোলা অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশকে একটি স্বাধীন ও খাদ্য-জ্বালানী সংকট-মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করার খুব সহজ উপায় রয়েছে।

এছাড়া সার্বিকভাবে ইসলামের বাস্তবায়ন দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে।

ইসলামী অর্থনৈতিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে মানবিক করে তোলে। এ থেকে শুরু করে মালিকানা ব্যবস্থা এবং বাস্তব খাতের উপর ভিত্তিতে বাজারে সংকট-প্রতিরোধী মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

১. ইসলামী অর্থনৈতিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা মানুষকে মানবিক করে তোলে। ইসলামী অর্থনৈতিক রাজনীতি হল প্রত্যেকের প্রাথমিক চাহিদা (বস্ত্র, খাদ্য ও বাসস্থান) পূরণের গ্যারান্টি এবং সেইসাথে একটি নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তি হিসাবে স্বাতন্ত্র্যসূচক জীবনধারার অধিকারী ব্যক্তিদের তাদের সামর্থ্যের স্তর অনুসারে তাদের মাধ্যমিক এবং তৃতীয় স্তরের চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি দেয়।

এটি উপলব্ধি করার জন্য রাষ্ট্র দেশীয় চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি ধারাবাহিক নীতি গ্রহণ করতে পারে। দেশীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ না হলে রপ্তানি মূল লক্ষ্য নয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানি এবং খাদ্য মওজুদের জন্য রাষ্ট্র খাদ্য ও জ্বালানির সম্প্রসারণ এবং তীব্রকরণ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞ মানবসম্পদ তৈরি করে প্রযুক্তিগত গবেষণা এবং খাদ্য শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করে, যাতে আমদানির উপর নির্ভর না করে সংশ্লিষ্ট সকল চাহিদা পূরণ করা যায়। সার, ওষুধ এবং অন্যান্য কৃষি উৎপাদন সুবিধা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সক ক্ষেত্রে, যাতে বাজারে অন্যায় অর্থনীতির বিস্তার না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য, ন্যায়বিচার রক্ষায় জন্য রাষ্ট্র সক্রিয় ভুমিকা রাখে।

খাদ্য মজুদ করতে পছন্দ করে এমন মওজুদদার ব্যক্তিদেরকে মওজুদদারী করতে বাধা দেয়, ফলে অর্থনৈতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়না তা নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে; বাজার প্রক্রিয়া অনুযায়ী মূল্য গঠন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান; ব্যবসায়িক গুণ্ডা এবং অসাধু ব্যক্তিদের কারণে বাজারে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে অত্যাচারের সম্ভাবনা থাকে তা প্রতিরোধ করে।

২. মালিকানা ব্যবস্থা: ইসলামে মালিকানার ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা: (১) ব্যক্তিগত সম্পত্তি; (২) সরকারী সম্পত্তি; (৩) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পত্তি।

জ্বালানী সরকারী সম্পত্তির শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাদ্য ব্যবসা ব্যক্তিগত বিভাগে অন্তর্ভুক্ত থাকে। ব্যক্তি মালিকানার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শুধুমাত্র নিশ্চিত করে যে বাজারে কোনো বিকৃতি নেই। প্রতারণামূলক, অন্যায্য এবং খাদ্যপণ্য মজুদকারীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সক্রিয় থাকে।  খাদ্য ব্যবসায় নির্দিষ্ট করে কোন বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য কোন বিশেষ সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে ইসলামী অর্থনীতি খাদ্য বাজারের একচ্ছত্রতা রোধ করে।

ইসলামী বিশ্বের বাজার হল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজার যা সকল নাগরিককে শরিয়া দ্বারা অনুমোদিত উপায়ে ব্যবসা করার সমান অধিকার প্রদান করে।

জ্বালানির ক্ষেত্রে ইসলাম মনে করে যে উৎসের আইন অনুাযায়ী তা মানুষের জন্য। জ্বালানীর পণ্য স্বয়ং এমন পণ্য নয় যা নিয়ে ব্যবসা করা যেতে পারে। জ্বালানি যেন কম দামে নাগরিকরা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

ইসলামী নীতির বাস্তবায়ন জ্বালানি সেক্টরে সকল প্রকার কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে। খিলাফত ভিত্তিক রাষ্ট্র কখনই প্রাইভেট কোম্পানীকে জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে না। আর বিদেশী প্রাইভেট কোম্পানীসমূহকে এ সুযোগ দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। খিলাফত ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে জ্বালানি খাতের সমস্ত ব্যক্তিগত মালিকানা শীঘ্রই রাষ্ট্রের হাতে চলে যাবে। ফলে তার ফল ভোগ করবে সমগ্র সমাজ। বিদ্যমান জ্বালানির উৎস ছাড়াও, রাষ্ট্র জ্বালানিকে তীব্র এবং প্রসারিত করার জন্য প্রযুক্তির বিকাশ করবে; এছাড়াও নতুন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির উত্স আবিস্কারের জন্য জোর করার চেষ্টা করে।

৩.  একটি সংকট-প্রতিরোধী মুদ্রা ব্যবস্থা: বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে কাগজের মুদ্রা, যা সোনা ও রূপার উপর ভিত্তি করে তৈরী নয়। ফলস্বরূপ, বিশ্ব বিনিময় হারে একটি মুদ্রার মান অবনতির প্রবণতা থাকে, সময়ে সময়ে মুদ্রার মান কমে যায়, বিশ্ব অর্থনীতিতে অবিরাম মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে থাকে। ইসলামে মুদ্রা অবশ্যই স্বর্ণ এবং রৌপ্য মানে হতে হবে। সিলভার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড সহ মুদ্রার একটি স্থিতিশীল বিনিময় হার রয়েছে এবং যা মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধী।

৪.  বাস্তব খাত-ভিত্তিক বাজার: ইসলামী অর্থনীতি হল বাস্তব খাতের উপর ভিত্তি করে একটি অর্থনীতি। ইসলাম পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতো অবাস্তব খাতকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলাম শুধুমাত্র কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও সেবার মতো বাস্তব খাতে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে স্বীকৃতি দেয়। এই খাত থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে উৎসাহিত করা হয়। ‍

সূত্র : এবাউট ইসলাম

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03