তিতুমীর : এই দিনে ধরনীতে এসেছিলেন যে বীর


মোঃ আবু বকর সিদ্দিক
Published: 2023-01-27 23:49:20 BdST | Updated: 2024-05-14 18:43:44 BdST

"এক যে ছিল বীর নামটি তিতুমীর বাঁশের লাঠি দিয়ে ভাঙ্গতো সে জিঞ্জির" - এ গানটিতে সেই বীরের কথাই বলা হচ্ছে, যে অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। আজ ২৭ জানুয়ারী সেই মহান বীরের জন্মদিন। আজ থেকে প্রায় ২৪১ বছর পূর্বে ১৭৮২ খ্রীঃ পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনার বারাসতের মহকুমার চাঁদপুর (মতান্তরে হায়দারপুর) গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি।

পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় প্রায় একই সময়ে দুটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের শুরু হয়। পূর্ব বাংলার আন্দোলনটি ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। পীর মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনকারী। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথ নির্দেশনা দানকারী ঐতিহাসিক ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ তার পিতা। আর পশ্চিম বাংলার আন্দোলনের নাম ওয়াহাবি আন্দোলন বা ‘তারিক-ই-মুহম্মদিয়া’। পশ্চিমবঙ্গে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিতুমীর। তিতুমীরের আসল নাম মীর নিসার আলী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। ভারতবর্ষের পরাধীনতাকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করার জন্য তিতুমীর ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে নারকেলবাড়িয়ায় এক দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। তিনি ব্রিটিশ শাসন ও তাদের অনুগত অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।

জন্ম ও পরিচয়

তিতুমীরের প্রকৃত নাম সাইয়িদ মীর নিসার আলী। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চাঁদপুর (মতান্তরে হায়দারপুর) গ্রামে ১৭৮২ খ্রীঃ ২৭ জানুয়ারী ১১৮৮ বঙ্গাব্দের ১৪ মাঘ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সাইয়িদ মীর হাসান আলী এবং মাতা আবিদা রোকাইয়া খাতুন। তিতুমীরের পরিবারের লোকেরা নিজেদের হযরত আলীর (রাঃ) বংশধর বলে দাবি করতেন। তাঁর এক পূর্বপুরুষ সাইয়িদ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আসেন। শাহাদাত আলীর পুত্র সাইয়িদ আবদুল্লাহ দিল্লির সুলতান কর্তৃক জাফরপুরের প্রধান কাজী নিযুক্ত হন এবং তাঁকে ‘মীর ইনসাফ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। শাহাদাত আলীর বংশধরগণ ‘মীর’ ও ‘সাইয়িদ’ উভয় পদবীই ব্যবহার করতেন।

‘তিতা’ থেকে ‘তিতু’
নিসার আলী নামের এই ছেলের নাম তিতুমীর হয়ে যাওয়ার পিছনে ছিল তাঁর ‘তিতা’স্বাদের প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগের একটি ঘটনা। ছোটবেলায় তার এক কঠিন অসুখ করেছিল। সে অসুখের ওষুধ প্রচণ্ড তিতা স্বাদের হওয়ায় বাবা-মা চিন্তায় পড়েছিল যে এই ওষুধ তো এই ছোট ছেলেকে খাওয়ানোই যাবে না। কিন্তু নিসার আলীকে ওষুধ খেতে দেয়ার পরে দেখা গেল পুরো উল্টো দৃশ্য। খুব মজা করে সেই তেতো ওষুধ বালক নিসার আলী খেয়ে ফেললো। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালেও দেখা গেল তিতা স্বাদের প্রতিই বালক নিসারের বেশি আগ্রহ। ঐ অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আশেপাশে সর্বত্র তার নাম ‘তিতা’ থেকে ‘তিতু’হয়ে গেল। বংশ ঐতিহ্যের মীর পদবী যুক্ত হয়ে কালক্রমে ‘তিতু’হয়ে গেল ‘তিতুমীর’- আর চিরকালের জন্য চাপা পড়ে গেল তার মূল নাম নিসার আলী।

শিক্ষাজীবন
গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিতুমীর স্থানীয় এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তিনি ছিলেন কুরআনে হাফেজ, বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ এবং আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী। তিনি ইসলামি ধর্মশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, দর্শন, তাসাওয়াফ ও মানতিক বিষয়ে সুপন্ডিত ছিলেন। মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিতুমীর একজন দক্ষ কুস্তিগীর হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।

হজ্জব্রত পালন
তিতুমীর ১৮২২ সালে হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কাশরীফ যান এবং সেখানে তিনি বিখ্যাত ইসলামি ধর্মসংস্কারক ও বিপ্লবী নেতা সাইয়িদ আহমদ বেরেলভী সান্নিধ্য লাভ করেন। সাইয়িদ আহমদ তাঁকে বাংলার মুসলমানদের অনৈসলামিক রীতিনীতির অনুশীলন এবং বিদেশি শক্তির পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।

সংগ্রামী তিতুমীর ও বাঁশের কেল্লা
১৮২৭ সালে মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিতুমীর চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি অনুশাসন প্রচার শুরু করেন। তিনি মুসলমানদের শিরক ও বেদআত অনুশীলন থেকে বিরত থেকে ইসলামের অনুশাসন মোতাবেক জীবনযাত্রা পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করেন। বিশেষ করে তাঁতি ও কৃষকদের মধ্যে তিনি ব্যাপক প্রচারকার্য চালান। অচিরেই মুসলমানদের প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং তাদের উপর অবৈধ কর আরোপের জন্য পুরার হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। কৃষককুলের উপর জমিদারদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে অপরাপর জমিদারদের সঙ্গেও তিতুমীর সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এসব অত্যাচারী জমিদার ছিলেন গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়।

এ প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা এবং কৃষকদের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে তিতুমীর এক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে তাদের লাঠি ও দেশিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দান করেন। তাঁর অনুসারী ও ভাগিনেয় গোলাম মাসুমকে বাহিনীর অধিনায়ক করা হয়। তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালায়। গোবরডাঙার জমিদারের প্ররোচনায় মোল্লাহাটির ইংরেজ কুঠিয়াল ডেভিস তার বাহিনী নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং যুদ্ধে পরাজিত হন। তিতুমীরের সঙ্গে এক সংঘর্ষে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হন। বারাসতের কালেক্টর আলেকাজান্ডার বশিরহাটের দারোগাকে নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান করে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। এ সময়ে তিতুমীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের নিকট জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় নি।

১৮৩১ সালে ২৩ অক্টোবর উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসতের নারিকেলবেড়িয়া গ্রামে তিনি বাঁশের কেল্লা তৈরী করেন। কেল্লা তৈরী হয় বাঁশ ও মাটি দিয়ে। এই কেল্লাই ছিল বারাসত বিদ্রোহের সদর দফতর।তিতুমীর তাঁর মুজাহিদ বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ নিয়োগ করে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দান করেন। অচিরেই মুজাহিদদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারে উপনীত হয়। সামরিক প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে তিতুমীর অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। অচিরেই তিনি চবিবশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিতুমীর তাকি ও গোবরডাঙার জমিদারদের নিকট কর দাবি করলে তারা ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। কলকাতা থেকে এক ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়। কিন্তু ইংরেজ ও জমিদারদের সম্মিলিত বাহিনী মুজাহিদদের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।

বিদ্রোহ দমন করতে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ স্থানীয় পদাতিক, দুটি কামানসহ গোলন্দাজ সৈন্যের এক নিয়মিত বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। প্রথমে ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারিদিকে ঘিরে ফেলেছিল। সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র, বল্লম, বর্শা. ও লাঠি এইসব নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা সৈন্যদলেরা ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু তিতুমীরতো এই যুদ্ধের আগেই বলেছিলেন, ভাই নব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে, লড়াইয়ে হার জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে হবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক, তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়, আমাদের কাছে থেকে প্রেরণা পেয়েই এদেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে, আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এ পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।

সূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক পত্রিকা

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


ইতিহাস বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


ইসলামের শুরু থেকেই মুসলমানদের হৃদয়ে শিক্ষার বিষয়টি ছিল সবার প্রথমে। ম...

ইতিহাস | 2021-11-18 20:20:27

আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ সভ্যতায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত সহজ...

ইতিহাস | 2022-03-29 16:14:42

ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে এমন অনেক ঘটনা থাকে, যা ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তিত...

ইতিহাস | 2022-04-18 22:09:33

১৯৭১, বাংলাদেশ ভূখন্ডের ইতিহাসেতো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় এ এক অবিস...

ইতিহাস | 2021-12-16 20:04:58

পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌছিয়েছে, তার ভিত্তিই...

ইতিহাস | 2021-12-17 19:50:08

এক যে ছিল বীর নামটি তিতুমীর বাঁশের লাঠি দিয়ে ভাঙ্গতো সে জিঞ্জির এ গানট...

ইতিহাস | 2023-01-27 23:49:20

আজ ৫ ডিসেম্বর। ১৮৪৫ সালের এই দিনে পীর মহসীনউদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে...

ইতিহাস | 2022-12-05 18:23:12

উজবেকিস্তানের তাসখন্দে সংরক্ষিত কুরআনের প্রাচীন একটি পান্ডুলিপিকে বিশ্...

ইতিহাস | 2022-02-28 13:21:44