বাবরী মসজিদ ট্রাজেডি : ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা


তারেক হাসান
Published: 2024-01-30 10:50:57 BdST | Updated: 2024-04-29 04:57:50 BdST

ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত প্রায় ৫শত বছরের প্রাচীন মসজিদ ছিল বাবরি মসজিদ। অনেক হিন্দুদের ধারণা বাবরি মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত সেটাই ছিল হিন্দু ধর্মের অবতার রামের জন্মস্থান। এই বিষয়টি নিয়ে আঠারো শতক থেকেই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছে, যা অযোধ্যা বিবাদ নামে পরিচিত। এ বিবাদের পরিণতি হচ্ছে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ট্রাজেডি। 

৪৯৬ বছরের ইতিহাস

বারবী মসজিদ নিয়ে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য প্রধান ঘটনা সমূহ (১৫২৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) :  

১৫২৮: মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮-২৯ সালে এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সম্রাট বাবরের  নামে নামকরন করেন।

১৯৯২ : বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, কর সেবক এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের  দ্বারা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর  এই মসজিদ আক্রমণ করা হয় এবং গুড়িয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে পুরো ভারত জুড়েই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গা পুরো ভারতজুড়ে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। হিন্দুদের মতে, মীর বাকী পূর্বে অবস্থিত রামমন্দির ধ্বংস করে তারপর মসজিদ নির্মাণ করেছে। আদৌ রামমন্দির ছিল কিনা তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভিন্নমত আছে।

১৯৪৯ : উনিশ শতকের শুরু থেকে এ বিতর্কের জের ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একাধিক কলহের ঘটনা ঘটে এবং পাল্টাপাল্টি আদালতে মামলা দায়ের চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালে হিন্দু সক্রিয়তাবাদীরা হিন্দু মহাসভার সাথে জোট বেধে গোপনে রামের একটি বিগ্রহ মসজিদের অভ্যন্তরে রেখে দেয়। এরপরই সরকার দাঙ্গা ঠেকানোর অভিপ্রায়ে পুরো মসজিদকে সিলগালা করে দেয়। হিন্দু-মুসলিম উভয়ই সে স্থানে প্রবেশাধিকার পেতে আদালতে মামলা করে।

২০১০ : সালে এলাহাবাদ উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখাড়া, রামলালার মধ্যে জমি সমান ভাগে করে দেয়া হোক। এর ফলে হিন্দুরা পায় জমির তিন ভাগের দুই ভাগ। মুসলিমরা এক ভাগ। এর বিরুদ্ধে সব পক্ষই উচ্চ আদালতে আপীল করে।

২০১৯ : নভেম্বর ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায়কে রদ করে ঘোষণা দেয় ২.৭৭ একরের পুরো জমিই এমন একটি ট্রাস্টকে দিতে হবে, যারা হিন্দু মন্দির নির্মাণ করবে। একই সাথে আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে মসজির নির্মাণের জন্য এবং সে জমি অযোধ্যায়ই হতে হবে।

২০২০ : ভারতের বিশেষ আদালত ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বের ১৯৯২ সাল থেকে ২৮ বছর ধরে চলা এই মামলার ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছে । সেই রায়ে অভিযুক্ত সবাইকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হয়েছে। লখনউয়ের বিশেষ আদালতে রায় পড়েন বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদব। অভিযুক্ত ৩২ জনকেই সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়। মসজিদ ভাঙার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উস্কানির অভিযোগ ওঠে বিজেপির বলিষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলিমনোহর যোশী, সাবেক মন্ত্রী কল্যাণ সিং ও উমা ভারতীর বিরুদ্ধে।

 রামমন্দিরের নির্মাণ কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়।

২০২৪ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, বহু বিতর্কের পর অবশেষে ভারতের অযোধ্যায় রামমন্দিরে বিগ্রহের 'প্রাণ প্রতিষ্ঠা' করলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রামমন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতি ছিলেন দেশ-বিদেশের অতিথিরা- যাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে শিল্পপতি, খেলা ও চিত্রজগতের তারকারাও ছিলেন। যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ এবং বিরোধী দলগুলোর নেতাদের প্রায় সবাই এই অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন এই অভিযোগ তুলে যে মি. মোদী রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য একে ব্যবহার করছেন। ভারতে কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, মন্দিরের নামে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।

মসজিদের নির্মাণকৌশল

দিল্লির সুলতানি এবং তার উত্তরাধিকারী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা শিল্প এবং স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাদের নির্মিত অনেক সমাধি, মসজিদ ও মাদ্রাসা সূক্ষ নির্মাণকৌশলের নিদর্শন বহন করে। বাবরি মসজিদ জানপুরের সুলতানি স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে। বাবরি মসজিদ তার সংরক্ষিত স্থাপত্য ও স্বতন্ত্র গঠনশৈলীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

স্থাপত্যশৈলী নকশা

এ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী দিল্লি সুলতানের মসজিদের একটি প্রতিলিপি ছিল। তবে বাবরী মসজিদ বিখ্যাত তার স্বতন্ত্র শৈলীর জন্য। বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরীণ শব্দ-নিয়ন্ত্রণ এবং শীতলীকরণের ব্যবস্থার জন্য। 

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের (১৮২৮-১৮৩৩) স্থাপত্যশিল্পী গ্রাহাম পিকফোর্ডের মতে, "বাবরি মসজিদ মিহরাব থেকে একটি ফিসফিস কথা ২০০ ফুট [৬০ মিটার] দূরে মসজিদের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায় এবং যেটি কেন্দ্রীয় আদালতের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের বরাবর।"

বাবরি মসজিদের স্বনবিদ্যা প্রসঙ্গে স্থাপত্যশিল্পী গ্রাহাম পিকফোর্ড তার বই Historic Structures of Oudhe -এ পাওয়া যায়, "মিম্বর থেকে কণ্ঠ স্থাপন ও প্রক্ষেপণ ষোড়শ শতাব্দীর একটি স্থাপনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নত, এই কাঠামোতে শব্দের অনন্য স্থাপনা দর্শনার্থীকে বিস্মিত করবে।

আধুনিক স্থপতিদের মতে বাবরি মসজিদের চিত্তাকর্ষক স্বনবিদ্যার কারণ হল মসজিদটির মিহরাব (মসজিদের একদিকে একটি অর্ধবৃত্তাকার দেয়াল যেটি ক্বিবলা নির্দেশ করে) ও পার্শ্ববর্তী দেয়ালগুলিতে বিভিন্ন খাঁজ যা অনুনাদক হিসাবে কাজ করত। এই নকশা মেহরাবে অবস্থিত ইমামের কথা (উপাসনা) সবাইকে শুনতে সাহায্য করত। এছাড়াও বাবরি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বেলেপাথর অনুনাদের কাজ করে যা মসজিদটির শব্দ-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করত।

আইনী লড়াইয়ে হাশিম আনসারি

পুলিশ দেহরক্ষীদের সঙ্গে মহম্মদ হাশিম আনসারি। ২০১৪ সালে তোলা ছবি।

বাবরি-রামমন্দির মামলায় মুসলিম পক্ষের সবচেয়ে পুরনো মামলাকারীদের একজন অযোধ্যার বাসিন্দা মহম্মদ হাশিম আনসারি। যিনি মারা গেছেন প্রায় ৯৬ বছর বয়সে, ২০১৬ সালে। পেশায় দর্জি হাশিম আনসারি আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন ১৯৪৯ সালে, রামলালার মূর্তি আবির্ভূত হওয়ার ঠিক পর পরই। ১৯৫২তে সেই মসজিদ প্রাঙ্গণে গিয়ে আজান দেওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে দু’বছর জেলও খাটতে হয়েছিল। পিতার অবর্তমানে হাশিম আনসারির ছেলে ইকবাল আনসারি মামলায় বাদী হিসেবে যুক্ত হন, কিন্তু ২০১৯-এ সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দিরের পক্ষে রায় দেওয়ার পর তিনি আর তা চ্যালেঞ্জ করেননি।

বাবরি মসজিদের স্মৃতি হিসাবে নতুন মসজিদ

অযোধ্যা মামলায় ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটি একটি ট্রাস্টকে দেওয়া যেতে পারে এবং সেখানে একটি রামমন্দির তৈরি করা যেতে পারে। একইভাবে, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বলা হয় যে, তাদেরকে পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে, যেখানে তারা একটি মসজিদ তৈরি করতে পারবে। রামমন্দিরের নির্মাণ কাজ ২০২০ সালে শুরু হয় এবং ২০২৪ এ শেষ হয়।যদিও সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা অযোধ্যায় বরাদ্দকৃত স্থানে মসজিদের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

সূত্র : উইকিপিডিয়া, বিবিসি। 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোর...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-05-18 16:38:37

ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুবই কম। আমি যেসব ক্যালিগ্রাফি করে...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-03-11 22:23:04

মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2017-10-28 15:34:39

হে আল্লাহ হে সমস্ত উদয়দিগন্ত ও অস্তাচলগামী আলোকরশ্মির মালিক আজকের এই প...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-06-13 02:59:21

সে নয় ঘরের কেউ, তবু ঘরেই ঘুমন্ত। অতিশয় শীর্ণ অবয়ব, এলোমেলো দীর্ঘ চুল,...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-06-10 02:26:13

যখন মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করবে যখন নিয়ে যাওয়া হবে আমার কফিনতুমি কখনোই এ...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-12-17 07:21:56

বইটি লেখার কাজ শুরু করা ২০১৬ সালের জুন মাসে। বই লেখার জন্য প্রথম যখন ত...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2018-02-26 00:27:10

বইটি যখন প্রথম পড়া শুরু করি, তখনও জানতামনা কতখানি চমক অপেক্ষা করছে। তা...

সাহিত্য ও সংস্কৃতি | 2017-11-16 15:02:20