ইসলামে শালীনতা, পোশাকের দর্শন ও বিধানাবলী : শাহ আবদুল হান্নান
শাহ আব্দুল হান্নান
Published: 2023-12-20 11:17:49 BdST | Updated: 2024-04-29 09:21:56 BdST
পুরুষ ও স্ত্রীলোকের পোশাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে ইসলামী আইন যথাযথ উপদেশ ও নির্দেশনা দান করেছে। ইসলাম যথাযথ পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে দু'টি বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রথমত, মানবদেহ ঠিকমত আচ্ছাদন করা। কারণ, বিশ্রীভাবে দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শন ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, সৌন্দর্যায়ন ও ভূষণ বাড়িয়ে তোলা। পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে বলা হয়েছে:
হে বনী আদম! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকবার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পোশাক দিয়েছি এবং সর্বোত্তম পোশাক হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক। (সূরা আরাফ: আয়াত ২৬)।
দেহ ঠিকমত আচ্ছাদন করা ও ভূষণের মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিত । যদি এই ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে যায় তাহলে শয়তানের পথ অনুসরণ করা হবে। এ সম্পর্কে কুরআন বলে:
হে বনী আদম! শয়তান তোমাদের প্রথম পিতামাতাকে যেভাবে বেহেশত থেকে বহিষ্কার করেছিল এবং তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান উভয়ের সামনে দেখানোর জন্য বিবস্ত্র করেছিল, তোমাদেরকে কিছুতেই শয়তান যেন সেভাবে প্রলুদ্ধ না করতে পারে। (সূরাআরাফ: আয়াত ২৭)।
পুরুষ ও স্ত্রীলোকের জন্য একই ধরনের পোশাক পরিধান করতে ইসলাম অনুমতি দেয়নি। ইসলাম পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যকার প্রভেদ রক্ষা করতে চায়। পুরুষ ও স্ত্রীলোকের একে অপরের পোশাক পরিধানের মধ্যে কোন বাহাদুরী নেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
পুরুষের স্ত্রীলোকের মতো পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ এবং স্ত্রীলোকের পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ।' (বুখারী)।
ইসলাম পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবহারে জাঁকজমক ও আড়ম্বরতা নিষিদ্ধ করেছে। কুরআন এ সম্পর্কে বলেছে:
‘আল্লাহ জাঁকজমকপূর্ণ (গর্বিত) লোককে পছন্দ করেন না।' (সূরা হাদীদ: আয়াত ২৩)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
'যে ব্যক্তি জাঁকজমক বা গর্ব দেখানোর জন্য তার পোশাক জমি পর্যন্ত স্পর্শ করায় (বিনা কারণে পোশাক লম্বা করে) আল্লাহ শেষ বিচারের দিনে তার দিকে তাকাবেন না।' (বুখারী)।
পোশাক-পরিচ্ছদ অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। কারণ, ইসলাম পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার উপর জোর দিয়েছে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন কর। কারণ ইসলাম ধর্মে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।' (ইবনে হারান)।
হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীলোকদেরকে স্বর্ণালংকার ও সিল্কের বস্ত্র পরিধান করার অনুমতি দিয়েছেন। তিনি এগুলো পুরুষদের পরিধান করার অনুমতি দেননি। এর কারণ, সম্ভবত এগুলো স্ত্রীলোকদের জন্যই
প্রকৃতিগতভাবে উপযুক্ত এবং পুরুষদের জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয় ।
পুরুষ ও স্ত্রীলোক অবশ্যই শালীনতাপূর্ণ পোশাক পরিধান করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ হচ্ছে যে, মানুষ তার দেহ যথাযথভাবে আচ্ছাদন করবে। পুরুষদের নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। এছাড়া অন্যান্য অংশ বিভিন্ন কারণে খোলা রাখা যেতে পারে। স্ত্রীলোক অবশ্যই তার দেহ যথাযথভাবে ঢেকে রাখবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, একটি বয়স্ক মেয়ের জন্য তার দেহ খোলা রাখা ঠিক নয়। সে অবশ্যই তার মুখমণ্ডল ও হাতের সামনের অংশ খোলা রাখতে পারে। (আবু দাউদ তার হাদিস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন যে, স্ত্রীলোকদের এমন পাতলা পোশাক পরতে অনুমতি দেওয়া হয়নি যা তার শরীর দেখাতে পারে। (ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন)। ইসলাম মেয়েদের বয়স হওয়ার পর ভাল করে বুক ঢেকে ওড়না পড়তে বলেছে। ফ্যাশনের নামে অনেক কিশোরী ও যুবতী ওড়না পরা বাদ দিয়েছে। অনেকে আবার গামছার মতো ওড়না গলায়
জড়িয়ে রাখছে অথবা একদিক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখছে । ওড়না গামছা নয়; যা দিয়ে ভাল করে মাথা ও বুক ঢাকা হয় না তাকে ওড়না বলা চলে না। এই প্রবণতা রোধ করা প্রয়োজন। তা না হলে পরবর্তীকালে কিশোরীদের মধ্য পাশ্চাত্যের মতো স্কার্ট ও হাফ প্যান্ট পরার রেওয়াজ চালু হয়ে যেতে পারে।
সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক নারীদের ওড়না পরার নির্দেশ দিয়েছেন। আয়াতটি হলো:
মুসলিম নারীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে; তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশপায় তা ব্যতীত তাদের সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার ওড়না দিয়ে আবৃত করে। (সূরা নূর: আয়াত ৩১)।
উপরের বিধান ঘরে-বাইরে দু'স্থানেই প্রযোজ্য। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সূরা নূরের ৩০নং আয়াতে পুরুষদেরকেও তাদের দৃষ্টি সংযত রাখার ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত আয়াতে ‘খুমুর’ (এক বচন ‘খিমার’) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । ‘খিমার’ শব্দের অর্থ 'ওড়না' বা চাদর জাতীয় পোশাক । জাহিলিয়াতের যামানায় স্ত্রীলোকেরা মাথার উপর এক প্রকারের চাদর দ্বারা পিছনের খোপা বেঁধে রাখত । সম্মুখের দিকের বোতাম খোলা থাকত। এতে গলা ও বুকের উপরাংশ স্পষ্ট দেখা যেত । বুকের উপর কোর্তা ছাড়া আর কিছু থাকত না (ইবনে কাসীর, কাশশাফ, মুহাম্মদ আসাদ লিখিত 'মেসেজ অব দি কুরআন', মাওলানা মওদুদীকৃত তাফহীমুল কুরআন, সুরা নূরের তাফসির অংশ)। এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুসলমান নারী ও কিশোরীদের মধ্যে ওড়না ব্যবহার করার রেওয়াজ চালু হয়। ঈমানদার মহিলারা এ নির্দেশ শুনে অনতিবিলম্বে তদনুযায়ী আমল শুরু করেন। এর প্রশংসা করে হযরত আয়েশা (রা:) বলেছেন, যখন সূরাটি নাযিল হয় তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হতে লোকেরা শুনে নিজের স্ত্রী, কন্যা ও বোনদেরকে এ আয়াতের কথা শুনায়। আয়াত শুনে প্রত্যেকে উঠে ওড়না বা চাদর দিয়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে নেয়। পরের দিন ফজরের নামাজে যত স্ত্রীলোকই মসজিদে নববীতে হাজির হয় তারা সকলেই ঐভাবে ওড়না বা চাদর পরা ছিল। এ পর্যায়ের আর একটি বর্ণনায় হযরত আয়েশা (রা:) বলেন যে, নারীরা পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে মোটা কাপড়ের ওড়না বানিয়ে নিয়েছিল। (তাফসিরে ইবনে কাসীর, আবু দাউদ, কিতাবুল লিবাস; তাফহীমূল কুরআন, সূরা নূরের তাফসির)।
উপরের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয় যে, মাথা ও বুক ঢেকে নারী ও কিশোরীদের ওড়না পরার নির্দেশ কুরআন থেকে এসেছে। এটা কারো বানানো বিধান নয়। অথচ অধিকাংশ লোক জানে না যে, ওড়না পরা কুরআনের নির্ধারিত অবশ্য কর্তব্য। এছাড়া অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে ‘গায়ের মাহরামদের' (অর্থাৎ যাদের সঙ্গে কোনো নারীর বিবাহ বৈধ) সামনে মাথা ঢাকা ফরজ এবং চেহারা, হাতের সামনের অংশ ও পায়ের পাতা ছাড়া শরীরের কোনো অংশ খোলা রাখা বৈধ নয় । (আবু দাউদ ও হিদায়া, নজর অধ্যায়)।
পোশাকের ফ্যাশনের নামে কুরআনের বিধান অমান্য করে আজ ওড়না উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অনেকে করছেন। অনেক বয়স্ক মেয়েকে ওড়না ছাড়া বাইরে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠানাদিতেও ওড়না ছাড়া মেয়েদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে ও অংশগ্রহণকরতে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ওড়না ব্যবহার ইসলামী শালীনতার সর্বোত্তম উদাহরণ। বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে এ সংক্রান্ত কুরআনের নির্দেশ কার্যকরী করা।
আমাদের পোশাক প্রস্তুতকারকদের প্রভাবিত করা কর্তব্য যেন তারা উপযুক্ত ওড়না ও শেলোয়ারসহ পোশাক ডিজাইন করে।আর তারা যেন এমন পোশাক ডিজাইন না করে যার মাধ্যমে সমাজে ইসলামী শিক্ষার বিরোধী বেহায়াপনা ছড়িয়ে পরে।
ইসলাম স্ত্রীলোকের সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা দেয় এবং খারাপ লোকদের ক্ষুধার্ত চক্ষু থেকে নিরাপদে রাখতে চায়। তাই ইসলাম স্ত্রীলোকদের তার সাধারণ পোশাকের উপরে চাদর ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে, যখন সে কাজের জন্য বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে বাইরে যায়। কুরআন এ সম্পর্কে বলেছে:
হে নবী! আপনার পত্নী, কন্যা ও মুমিনদের নারীদেরকে চাদর (মাথা ও বুক আচ্ছাদন করে) পরিধান করতে বলুন। এটাই ভালো স্ত্রীলোকের পরিচয়ের উত্তম পথ এবং এতে করে তাদের কখনও বিব্রত করা হবে না। (সূরা আহযাব: আয়াত ৫৯)।
চাদরটি বড় হওয়া সঙ্গত । চাদরের বুনন ভাল হওয়া প্রয়োজন । মহিলাদের দিকে নজর দেওয়া নিয়ে বিখ্যাত ফিকাহর গ্রন্থ হিদায়াতে প্রাথমিক যুগের হানাফী ইমামদের মতামত নিম্নলিখিতভাবে উল্লিখিত আছে, ‘বেগানা পুরুষের । নারীর চেহারা ও হাতের তালু ছাড়া অন্য অংশের দিকে দৃষ্টি করা জায়েজ নহে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘নারীরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, কেবল সে সৌন্দর্য ছাড়া যা স্বতই প্রকাশ হয়ে পড়ে।' তাছাড়া চেহারা ও হাত প্রকাশ করার প্রয়োজন আছে পুরুষদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজ-কারবারে লেনদেন করার জন্য। আবু হানিফা বলেছেন, পায়ের দিকেও নজর করা জায়েজ। কেননা ইহারও প্রয়োজন অনেক সময় দেখা দেয়। আবু ইউসুফ হতে বর্ণিত আছে হাতের কনুই পর্যন্ত দেখা জায়েজ । কারণ ইহাও অনেক সময় স্বতই প্রকাশ হয় । তবে কুচিন্তা হতে নিরাপদ না হলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চেহারার দিকে তাকাবে না।' (হিদায়া, নজর অধ্যায়)।
যদি মানব জাতি ইসলাম প্রদত্ত পোশাক-পরিচ্ছদের নীতি মেনে চলে, তাহলে তা অবশ্যই পুরুষ ও স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম নিশ্চিত করবে এবং একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে।
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: