পাশ্চাত্যের ভন্ডামি ও গণহত্যার মুখোশ গাজা যেভাবে উম্মোচন করেছে, যা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি


রামজী বারুদ
Published: 2024-03-06 23:29:55 BdST | Updated: 2024-04-29 05:46:48 BdST

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা পশ্চিমাদের নৈতিক পতন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

৭ অক্টোবরের পর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার সাথে সাথে ওয়াশিংটন এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রিয় বলে মনে করা প্রতিটি নৈতিক ও আইনী কাঠামো হঠাৎ করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমা নেতারা একের পর এক ইসরায়েলে ছুটে আসে, সামরিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সহায়তার প্রস্তাব দেয়, সেই সাথে ডানপন্থী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার জেনারেলদের ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের জন্য একটি ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দেয়।

যেমন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলের প্রথম যুদ্ধ পরিষদের বৈঠকে যোগদান করেন, যাতে তিনি সেই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন যা সরাসরি গাজা গণহত্যা শুরু করেছিল। ১২ অক্টোবর তিনি বলেন, "আমি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন ইহুদি হিসেবেও আপনাদের সামনে আসছি। এর ফলে সে একজন আমেরিকান, একজন রাজনীতিবিদ বা এমনকি একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসাবে সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তার বস, রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বছরের পর বছর ধরে এই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন যে "জায়নিস্ট হওয়ার জন্য আপনাকে ইহুদি হতে হবে না"। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা পালন করেছেন, বারবার ঘোষণা করেছেন, "আমি একজন জায়নবাদী"। প্রকৃতপক্ষে, তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসাবে, সেই সাথে অন্যান্য মার্কিন এবং পশ্চিমা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক এবং মানবিক আইনকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে, এমনকি তাদের নিজ দেশের আইনকেও। যেমন লিথি আইন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট এবং ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্সকে বিদেশী নিরাপত্তা বাহিনী ইউনিটগুলিকে সামরিক সহায়তা প্রদান থেকে নিষিদ্ধ করে যারা দায়মুক্তির সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এই আইন পালনের পরিবর্তে, তিনি ব্লিঙ্কেন-এর মতো, উপজাতীয় এবং মতাদর্শগত ধারণায় যুক্ত হয়েছিলেন, যা কেবল আগুনে জ্বালানি যোগ করেছিল।


যুদ্ধের শুরুতে, অনেকে গাজার প্রতি পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি সমান্তরাল চিত্র আঁকেন। এটা হয়তো তখন সঠিক ছিল। কিন্তু গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই তুলনাটি অপর্যাপ্ত বলে মনে হয়। গাজায় ১৪০ দিনের যুদ্ধে ১২০০০ এরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে, অপরদিকে দুই বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ৫৭৯ শিশু নিহত হয়েছে।


কখনও পরিস্থিতি এমন হয় যে তখন তাদের স্পষ্ট ভণ্ডামি লুকানো অসম্ভব হয়ে উঠে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাথু মিলার, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র, গাজা এবং ইসরায়েল উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ষণের অভিযোগের জবাবে তিনি যা বলেছেন তা লক্ষণীয়। ১৮ ফেব্রুয়ারিতে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, গাজায় ফিলিস্তিনি নারীদেরকে ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের অভিযোগ সম্পর্কে, তখন তার উত্তর ছিল “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে "বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এবং স্বচ্ছভাবে তদন্ত করার" আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের দ্বারা ইসরায়েলীদের উপর যৌন নিপীড়নের বিষয় তিনি খোলাখুলি বলেন, “তারা ধর্ষণ করেছে। আমাদের এই প্রতিবেদনগুলি নিয়ে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই”। ইসরায়েলীদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের অপ্রত্যাশিত অভিযোগ সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তরের সাথে এটির তুলনা করুন, যদিও ইসরায়েলের নিজস্ব মিডিয়াও তা অস্বীকার করেছে।

ইসরায়েলের ভয়াবহ সহিংসতা, দীর্ঘায়িত দখলদারিত্ব এবং জাতিগত বর্ণবাদ ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে বিশ্বজুড়ে কয়েক ডজন রাষ্ট্রদূত ১৯ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দূতকে বিশ্বের সর্বোচ্চ এই আদালতে পাঠিয়েছে  সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন কিছু করার জন্য।

ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভারপ্রাপ্ত আইনী উপদেষ্টা রিচার্ড ভিসেক উদ্ভটভাবে আই সিজে কে আন্তর্জাতিক আইনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছিল। তিনি বলেন, "আদালতের উচিত হবে না যে ইসরায়েলকে আইনতভাবে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে অধিকৃত অঞ্চল থেকে সরে যেতে বাধ্য।"

দীর্ঘ সময় ধরে, বিশেষ করে ৭ অক্টোবর থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পশ্চিমা সরকারগুলো নীতি- নৈতিকতা এবং আইনের সর্বশেষ ধারাটি লঙ্ঘন করে চলছে। যে আইন তারা নিজেরাই বানিয়েছে, খসড়া তৈরি করেছে, প্রচার করেছে, এমনকি বহু দশক ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর যা চাপিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে, তারা কার্যত তাদের নিজস্ব আইন এবং সেই নৈতিক মান সমূহকে ভেঙে ফেলছে, যা তাদেরকে সুগঠিত করেছিল।

এখন যখন কিছু পশ্চিমা নেতা গাজা গণহত্যার ব্যাপকতা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে  ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। এবং কয়েকজন যদিও লজ্জাজনকভাবে, ঘোষণা করছেন যে নেতানিয়াহু হয়তো 'বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলছে'। তা সত্ত্বেও, এমনকি সরাসরি দায়িত্ব স্বীকার করলেও এই সত্যটি মুছে ফেলবে না যে তারা নেতানিয়াহুর এই গণহত্যা অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

যখন সব বলা হবে এবং করা হবে, তখন ভয়ঙ্কর সংখ্যক ফিলিস্তিনি শিকারের রক্ত তেল আবিব, ব্রাসেলস, লন্ডন, সিডনি এবং অন্যান্য সকল গণহত্যা ক্ষমাকারীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে। এই মাত্রার একটি অপরাধ কখনও ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না এবং ক্ষমা করা হবে না।


লেখক : ড. রামজি বারুদ

[Dr. Ramzy Baroud একজন সাংবাদিক, লেখক এবং The Palestine Chronicle এর সম্পাদক। তার সর্বশেষ বই Our Vision for Liberation: Engaged Palestinian Leaders and Intellectuals Speak Out । তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে My Father was a Freedom Fighter এবং The Last Earth । জনাব রামজি বারুদ সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স (সিআইজিএ) এর একজন অনাবাসী সিনিয়র রিসার্চ ফেলো]

সূত্র : রেডিয়েন্স নিউজ

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03