পূণ্যভূমি ইয়েমেন, ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধাদের আপোষহীন লড়াই এবং ফিলিস্তিনের সমর্থনে লোহিত সাগরে ড্রোন হামলার প্রভাব


তারেক হাসান
Published: 2024-03-03 00:10:13 BdST | Updated: 2024-04-29 01:29:53 BdST

ইয়েমেন দেশ পরিচিতি :

ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। সানা’আ ইয়েমেন প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইয়েমেনের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। এটি আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বাব এল মান্দেব প্রণালীর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান অবস্থিত। প্রায় তিন কোটি মুসলিম জনসংখ্যার এই আরব দেশটি আন্তর্জাতিক সম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের ষড়যন্ত্রের শিকার। মুসলিমদের নিকট মর্যাদাপূর্ণ এই আরব দেশটির মোট আয়াতন প্রায় ৫ লক্ষ ২৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। জন সংখ্যার ৬৫% সুন্নি এবং ৩৫% শিয়া মতাবলম্বী। 

মুসলিমদের নিকট ইয়েমেনের গুরুত্ব ও মর্যাদা:

ইয়েমেন ভূখণ্ডকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ সম্মান দান করেছেন। হাদীসে পবিত্র মক্কা-মদিনা ও বায়তুল মোকাদ্দাসের পর এই দেশে ও ইহার অধিবাসীদের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুল (সা.) আকাশের দিকে মুখ করে বললেন, ইয়েমেনের মানুষজন তোমাদের কাছে মেঘমালার মতো এসেছে, তারা বিশ্বাসীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৭৫৮)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ইয়েমেনবাসীরা তোমাদের কাছে এসেছে। তাঁরা অন্তরের দিক থেকে অত্যন্ত কোমল। আর মনের দিক থেকে অত্যন্ত দয়াবান। ফিকহ হলো ইয়েমেনিদের, আর প্রজ্ঞা হলো ইয়েমেনিদের। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৩৯০)

রাসুল (সা.) নিজেকেও ইয়েমেনের অধিবাসী দাবি করে ইয়েমেনকে বিশেষ সম্মান করেছেন। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ঈমান ইয়েমেনের এবং তারা আমার থেকে, আমার প্রতি সম্পৃক্ত অবস্থানের দিক থেকে তারা যত দূরেই হোক। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ১৬৬২৪)

আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, একদা ইয়ামানবাসীরা এসে উপস্থিত হলে রাসুল (সা.) বললেন, তোমাদের কাছে ইয়েমেনবাসীরা এসেছে। আর এরাই সর্বপ্রথম মুসাফাহা করেছে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫২১৩)

রাসুল (সা.) পবিত্র মুখে ইয়েমেনবাসীর জন্য বরকতের দোয়া করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০৩৭) ইয়েমেনবাসীকে আল্লাহর রাসুল (সা.) বিশ্বস্ত বলে ঘোষণা করেছেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৯৩৬)

সাওবান (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেন, আমি আমার হাউসে কাওসারের পাশে থাকব। ইয়েমেনবাসীর জন্য সর্বসাধারণ লোককে সরিয়ে দেব। আমি আমার লাঠি দিয়ে হাউসের পানির ওপর আঘাত করব, যাতে তাদের ওপর তা প্রবাহিত হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৮৮৪)

উপরোক্ত হাদীস সমূহের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে ইয়েমেন ও ইয়েমেন বাসীদের মর্যাদা প্রমাণিত হয়। 

ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধাদের আপোষহীন লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত:

তিউনিশিয়ায থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্ত দুই দশকেরও বেশি সময় যাবৎ ক্ষমতায় থাকা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের রাষ্ট্রপতি আলী আবদুল্লাহ সালেহের স্বেচ্ছাচার ও নজিরবিহনি দূর্নীতির কারণে ২০১১ সালে তাকে অপসারণের জন্য আন্দোলনের সূচনা হয়। হুথি যোদ্ধারা এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।

২০১২ সালে প্রারম্ভে ইয়েমেন সরকার ও বিদ্রোহী দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আলোকে সালেহের ক্ষমতা ত্যাগের পর তার প্রাক্তন উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান মানসুর হাদি ক্ষমতায় আসে। অপরদিকে সৌদি আরব এবং আরও অন্যান্য কিছু দেশ ঘোষণা করে যে তারা ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করছে। বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, জর্দান, মরোক্কো এবং সুদান এ জোটের সদস্য। তাদের লক্ষ্য ইয়েমেনে "হুতি আন্দোলনকে প্রতিরোধ করা"।

২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে হুথি যোদ্ধারা এভাবে লড়াই করে আসছে। হুথিদের ড্রোন আক্রমন শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৯ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে তারা এটা ব্যবহার করতে থাকে। 

২০২২ সালে ইয়েমেনের নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান মানসুর হাদি ক্ষমতা হস্তান্তর করলে রাশাদ আল-আলিমি পদে বসে। বর্তমানে রাজধানী সানা সহ ইয়েমেনের বেশিরভাগ এলাকা হুতিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরদিকে এডেনভিত্তিক ইয়েমেন সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট আল-আলিমি।  

২০২৩ সালের মার্চে জাতিসংঘ ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট বলে আখ্যা দেয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ২ কোটি ১৬ লক্ষ বা ইয়েমেনের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের জন্য জরুরিভাবে মানবিক সহায়তা এবং সুরক্ষা সেবা প্রয়োজন।

গাজায় ইসরায়েলী বর্বরতার প্রতিবাদে লোহিত সাগরে হুথি যোদ্ধাদের ড্রোন হামলা:

২০২৩ সালের ৭ ই অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলী আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধারা ১৮ নভেম্বর গ্যালাক্সি লিডার নামে একটি কার্গো জাহাজ দখল করে নেয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুটে চলাচলকারী মালবাহী জাহাজে হামলা চালিয়ে আসছে হুথি সেনারা। মূলত ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোর পণ্যবাহী জাহাজকে লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে তারা।

গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হচ্ছে ইতিহাসের প্রথম সরাসরি সম্প্রচারিত গণহত্যা। যা ৭ অক্টোবর থেকে ৩০ হাজারের এরও বেশি ফিলিস্তিনির জীবন নিয়েছে। এই অনস্বীকার্য মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পশ্চিমা সরকারগুলো কোনো অর্থবহ পদক্ষেপ নেয়নি।

কয়েক হাজার বেসামরিক লোকের হত্যা, পঙ্গুত্ব ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পশ্চিমা দেশগুলির কোন উদ্বেগ দেখা যায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব আল-মান্দেব প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্যিক জাহাজ সমূহের হুথি যোদ্ধাদের দ্বারা বেশ কয়েকটি অ-মারাত্মক আক্রমণ এই পশ্চিমা দেশগুলিকে সক্রিয় করে তোলে।

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্রদের ধারাবাহিক পাল্টা হামলা:

বিপদ আঁচ করতে পেরে হুথিদের এই হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গত ১১ই জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে যৌথ হামলা চালিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় হুথিদের ১০টি ড্রোন ধ্বংস হয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় দফার যৌথ হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় সমর্থন দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড। একটি যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইয়েমেনের ১৩ টি লোকেশনের ৩৬ টি টার্গেটে এই হামলা চালানো হয়। এর লক্ষ্যবস্তু হিসেবে "অস্ত্র মজুদ কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং লঞ্চার, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রাডার" এ হামলা চালানো হয়েছে । ২৫ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনে হুথিদের উপর নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে দুই মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এ নিয়ে গত দেড় মাসে চতুর্থ বারের মতো যৌথ হামলা চালালো দেশ দু'টি। এই বিমান হামলায় হুথিদের অন্তত ১৮টি স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগন। হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল হুথিদের ব্যবহৃত হেলিকপ্টার, ড্রোন, রাডার, অস্ত্র গুদাম এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ড এই হামলাকে সমর্থন দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বহুপাক্ষিক জোট গঠন করে। জোটে এখন ২০টির বেশি দেশ রয়েছে বলে জানিয়েছে পেন্টাগন।

বহু ক্ষতি স্বীকারের পরও অব্যাহত রয়েছে হুথি যোদ্ধাদের আক্রমণ:

হুথি যোদ্ধারা গত ১৯ তারিখে ব্রিটিশ জাহাজে আঘাত করে, ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করে। ইউ এস নেভাল ইনস্টিটিউট প্রতিবেদন করে যে, হুথিদের প্রাণঘাতী আন্ডারওয়াটার ড্রোন লোহিত সাগরে নতুন হুমকি যোগ করেছে। হুথিদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত জাহাজ থেকে লোহিত সাগরে তেল স্খলনের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্যের অর্ধেক রপ্তানিকারক বলছে, লোহিত সাগরে হুথি হামলা ব্যবসা ব্যাহত করছে।

২৯ ফেব্রুয়ারী হুথিদের পাঁচটি ড্রোন ভুপাতিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। লোহিত সাগরে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট সব জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করছে হুথি সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দফায় দফায় পাল্টা হামলার পরও তাদের আক্রমণ বন্ধ হয়নি।

লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরকে সংযোগকারী বাব-এল-মান্দের প্রণালী ছাড়াও ইলাত শহরেও হুতিরা ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি ব্রিটেনে নিবন্ধিত ইসরায়েলগামী বেলিজের একটি জাহাজেও তারা হামলা চালায়। 

বিশ্বের কনটেইনারের ৩০ শতাংশ লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল ব্যবহার করে।গত কয়েক সপ্তাহে তারা মারিবের চারপাশে ৫০ হাজার যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। মারিব হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেনি সরকারের শেষ শক্ত ঘাঁটি।

ফেব্রুয়ারী মাসের শুরু পর্যন্ত ২৯টি জাহাজে আক্রমন করে বলে রয়টারের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

মুসলিম উম্মাহর জন্য হুথিদের ত্যাগ এবং পাশ্চাত্যের নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ:

হুথি যোদ্ধাদের হামলার কারণে শিপিং খরচ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য তারা যে ডলার এবং পাউন্ড হারাচ্ছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যের রক্তের নদীর চেয়ে "মুক্ত বিশ্বের" এই নেতাদের কাছে বেশি মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল।

বাব আল-মান্দেব প্রণালী পেরিয়ে লোহিত সাগর মধ্য দিয়ে সুয়েজ খাল পর্যন্ত এই নৌপথ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলপথ সমূহের মধ্যে একটি। অনুমান করা হয় যে উপসাগর থেকে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বেশিরভাগ রপ্তানি সহ সমস্ত বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১২ শতাংশ এই প্রণালী দিয়ে অতিক্রম করে। যার বাণিজ্য মূল্য প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ইউ এস ডলার।

ভূমধ্যসাগরের পূর্বে অবস্থিত ইসরায়েল তার বেশিরভাগ পণ্যের জন্য এই বাণিজ্য রুটের উপর নির্ভর করে। তাদের এই নির্ভরতার কারণে হুথি সংগঠন বাব আল-মান্দেবের মধ্য দিয়ে যাওয়া ইসরায়েল-গামী এবং ইসরায়েল-মালিকানাধীন জাহাজ সমূহে হামলা ও আটক করতে শুরু করে। তারা বলেছে যে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে বা অন্তত পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তার অনুমতি দিলে তারা এই হামলা বন্ধ করবে।

লোহিত সাগরের জাহাজ সমূহে হুথি হামলা হলিউড অ্যাকশন মুভির দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। এসকল হামালায় এ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু জাহাজের বেসামরিক ক্রুদের মধ্যে কোন প্রাণহানি ঘটেনি, তবে ইসরায়েল এবং তার সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। অনুমান করা হয় যে হুথি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে, ইসরায়েলের প্রধান বন্দর ইলাতে কার্যক্রম ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

প্রাক্তন সিআইএ বিশ্লেষক, বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন এর সিনিয়র ফেলো  ব্রুস রিডেল বলেন, আমরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরান থেকে হুথিদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর রোধ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এটি কাজ করেনি।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হুতিদের ‍উপর হামলার জন্য সবসময় কিছু অজুহাত দেয়। কখনো জাতিসংঘের মাধ্যমে শান্তির বার্তা প্রদান করে। যেমন ২৮ শে জানুয়ারি জর্ডানে তিন মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-সম্পর্কিত লক্ষ্যবস্তু টার্গেট করে মার্কিন বাহিনীর একতরফা ধারাবাহিক হামলার একদিন পরে মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনী ইয়েমেনে যৌথ বিমান হামলা চালায়। তবে সাবির্ক অবস্থা এটাই বলে যে, হুথি যোদ্ধারা গাজার গণহত্যা বন্ধ করতে পারেনি কিন্তু পাশ্চাত্যের নৈতিক দেউলিয়াত্ব উন্মোচিত করেছে।  

কিছু মিডিয়ার মানসিক দাসত্ব :

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের জীবন বাজি রেখে শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসা হুথি যোদ্ধাদেরকে অনেক মিডিয়া হুথি জঙ্গী গোষ্ঠী বা হুথি বিদ্রোহী ইত্যাদি নামে আখ্যা দিয়ে আসছে। মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশেও অনেক মিডিয়াও তাদের অনুসরন করছে। এটা পাশ্চাত্যের মিডিয়ার প্রতি তাদের মানসিক দাসত্বের প্রকাশ। 

হুথি যোদ্ধাদের আক্রমনের ইতিবাচক প্রভাব :

হুথিদের আক্রমণ ইয়েমেন এবং আশেপাশের অঞ্চলে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে এবং ইরান-সমর্থিত এই সংগঠনকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি সম্মানজনক এবং উল্লেখযোগ্য উদিয়মান প্রতিরোধ শক্তি হিসাবে সামনে নিয়ে এসেছে। 

এই আক্রমণ সমূহের কারণে তাদের শিপিং কোম্পানি সমূহ সম্পূর্ণরূপে লোহিত সাগরে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। এর ফলে বিকল্প পথে দূরত্ব অনেক বেড়ে যাওয়ায় পণ্য সরবরাহে গুরুতর বিলম্বের পাশাপাশি শিপিং খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, নভেম্বর মাসে এই মূল শিপিং রুটে প্রতিবন্ধকতা শুরু হওয়ায় আগের তুলনায় সাধারণ শিপিংয়ের মূল্য ৩২৯ শতাংশ বেশি বেড়েছে।

হুথি মুখপাত্র নাসর আল-দিন আমের বলেন, ‘হয় আমাদের ফিলিস্তিন এবং গাজায় শান্তি আছে, অথবা আমাদের অঞ্চলে আপনার জন্য কোন শান্তি বা নিরাপত্তা নেই।’তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, আমরা ক্রমবর্ধমান হামলার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করব।

হুতির প্রধান নেগোশিয়েটর ও মুখপাত্র মোহাম্মদ আবদুল সালাম ডিসেম্বরে আল জাজিরাকে বলেন, আমাদের অভিযানগুলো গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের আগ্রাসনের মুখে আমরা অলস দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হামলার পর হুতি সংগঠন বলেছে তারা ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজে হামলা চালিয়ে যাবে। আবদুল সালাম অনলাইনে লেখেন, তারা যদি মনে করে যে, ফিলিস্তিন ও গাজার প্রতি সমর্থন থেকে ইয়েমেনকে বিরত রাখবে, তবে তারা ভুল ধারনায় রয়েছে। গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়াতে ইসরায়েল যেন অনুমতি দেয়, হুতিরা সেই দাবি করে আসছে। 

পশ্চিমা দেশগুলো অবশ্যই এ সব এড়িয়ে যেতে পারত এবং অনেক ফিলিস্তিনির জীবন বাঁচাতে পারত, কেবল ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের অবসান ঘটাতে বাধ্য করে। ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করার কথা বলে বিরক্ত করার পরিবর্তে, পশ্চিমের নেতারা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশের বিরুদ্ধে আরেকটি বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা কেবল এটা দেখায় না যে তারা তাদের মিত্রদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে উদ্বেগ বোধ করে না, তারা এটাও দেখায় যে, তারা পশ্চিমা বাণিজ্যিক জায়ান্টদের লাভের মার্জিনকে মধ্যপ্রাচ্যের সকল ফিলিস্তিনির জীবনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দেয়।


সংকলন ও অনুবাদ : তারেক হাসান

সূত্র : আল-জাজিরা ও উইকপিডিয়া 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


মুসলিম বিশ্ব বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


শামীম সুলতানা একজন তরুণ মুসলিম মহিলা, সিঙ্গাপুরের নাগরিক এবং তিনি কায়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-21 22:32:39

তুর্কিয়ের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোগান জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাং...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-05-23 09:44:54

১৯৯৫ সালে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিকাতে প্রায় ৮ হাজার বসনিয়...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-15 19:48:15

সুদান ভেঙ্গে আবারও নতুন দেশের উদয় হবে বলে ইসরাইল আশা করছে

মুসলিম বিশ্ব | 2023-04-29 02:07:05

২৮ জুন স্টকহোম সেন্ট্রাল মসজিদের বাইরে কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে বিশ্বব...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-01 04:57:28

রাশিয়ার বৃহত্তম ঋণদাতা Sberbank-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গনিয...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-07-14 03:30:52

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৩ সালকে একটি একটি কঠিন অর্থনৈতিক বছর...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-06-13 23:28:54

রাজধানী খার্তুম, দারফুর ও কর্ডোফান রাজ্যে হত্যা, লুটপাট এবং ধর্ষণ সহ ন...

মুসলিম বিশ্ব | 2023-08-30 12:58:03