কোর’আনের শিক্ষায় জীবন গড়ার পাঁচটি উপায় জেনে নিন!
মূলঃ আবু হামিদ আল গাজালি; ভাষান্তরঃ সাদিক হাসান
Published: 2018-08-15 23:24:11 BdST | Updated: 2024-05-15 13:41:45 BdST
রাসূল স. বলেছেনঃ
বেশি বেশি কোর’আন তেলা’ওয়াত কর, কেননা হাশরের দিন এ কোর’আন তাঁর তেলাওয়াত কারীর পক্ষে সুপারিশ করবে। (মুসলিম)
কোর’আন এমন এক মহামান্বিত কিতাব যা আমাদের সরল সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির বিধান করে থাকে। এই কোর’আনের বাহ্যিক মহত্ত্বের পাশাপাশি কিছু গোপন সৌন্দর্য রয়েছে যেগুলো আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। এখানে আমরা সেই সৌন্দর্যগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
কোর’আনের এ সুপ্ত সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে হলে পাঁচটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখতে হবে।
১. প্রতি শব্দের মহত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করা
পাঠের শুরুতেই যদি আপনি শব্দমালার মহত্ত্ব অনুধাবন করতে পারেন তবে অবশ্যই যিনি (আল্লাহ) এই শব্দমালা পাঠিয়েছেন তাঁর মহত্ত্বও অনুধাবন করতে পারবেন।
আপনি যখন কোর’আন বুঝে অধ্যয়ন করবেন, তখন সহজেই হৃদয়ে অনুধাবন করতে পারবেন আল্লাহর আরশ, কুরসি, উপরের বিশাল আকাশ, জমিন, মানুষ, জ্বীন, গাছপালা, পশুপাখি সবই একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি এবং তারই ক্ষমতা ও দয়ায় বেঁচে আছে। আল্লাহর কালাম আপনি যতই পড়তে থাকবেন, দেখবেন আল্লাহর ক্ষমতা, জ্ঞান, দয়া, মমতা আপনি অনুভব করছেন এবং আপনার মন আরও বেশি বেশি জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কোর’আন যেমন শুধু পাক পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না, তেমনি এ কোর’আনের গোপন সৌন্দর্য ও রহস্য যাদের অন্তর কলুষিত তারা দেখতে বা বুঝতে পারে না।
২. কোর’আন নিয়ে গভীরভাবে ভাবুন
যদি আপনি কোর’আনের অনুসারী হতে চান তবে যখন কোর’আন তেলাওয়াত করবেন, এর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। আপনি অবচেতন মনে যে অংশ তেলাওয়াত করেছেন তা নিয়ে আবার ভাবুন ও বুঝেশুনে অধ্যয়ন করুন; না বুঝে শুধু তেলাওয়াত যেন আপনার লক্ষ্য না হয় কারণ সুন্দরভাবে তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যই হল আরও ভাল করে কোর’আন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা।
আলী রাঃ বলেছেনঃ
“উপলব্ধি না করে ইবাদত করার মাঝে কোন ফায়দা নেই, তেমনি চিন্তা গবেষণা ছাড়া তেলাওয়াতেও কোন লাভ নেই।”
৩. জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করুন
আপনার উচিৎ জ্ঞান এমন জায়গা থেকে সন্ধান করা যেখানে জ্ঞান পাওয়া যায়, যেখানে মণিমুক্তা পাওয়া যায় সেখানেই আপনার তা খুঁজে দেখা উচিৎ। এমন জায়গায় আপনি মণিমুক্তার সন্ধান করেন না যেখানে এর কোন চিহ্নই নেই। তাই আপনার চিন্তা গবেষনা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে যখন আপনি প্রতিটি বিষয়ের আসল জায়গা চিনে নিয়ে গবেষণা চালাবেন।
আপনি প্রকৃত উৎস নিয়ে যথাযথ চিন্তা ও গবেষণা করবেন। কোর’আন আরও সহজ ও ভালভাবে বুঝার জন্য কোর’আনকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায় যেগুলো জানার মাধ্যমে আপনি কোর’আনকে আরও সহজভাবে বুঝতে ও তা নিয়ে চিন্তা করতে পারবেন। সেগুলোর কয়েকটি নিচে দেয়া হলঃ
১. কোর’আন সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত, এখানে আল্লাহর গুণাবলী ও কর্মের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তাই এখান থেকে প্রকৃত জ্ঞান ও দিক নির্দেশনা তালাশ করুন।
২. এ কোর’আন সঠিক পথ প্রদর্শক তাই এ থেকে প্রজ্ঞা, দয়া ও অনুকম্পা তালাশ করুন।
৩. এখানে আছে শত্রুদের পরাজয়ের কাহিনী, তা থেকে আহরণ করতে পারবেন সম্মান ও মর্যাদা এবং জয় ও পরাজয়ের জ্ঞান।
৪. এখানে আছে নবীদের কাহিনী, তা থেকে লাভ করতে পারেন দয়া, মহানুভবতা, অনুগ্রহ ও উদারতার জ্ঞান।
এভাবেই প্রতিটি আলাদা আলাদা শাখা থেকে আপনি প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারেন।
৪. যে বিষয়গুলো কোর’আন বুঝার অন্তরায় হতে পারে তা থেকে দূরে থাকুন
যে বিষয়গুলো কোর’আন বুঝার ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে সে ধরণের অভ্যাস পরিহার করুন কেননা এ সকল কারণে আপনি প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হবেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ
সুনিশ্চিতভাবেই আমি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছি যদিও তারা তা বুঝে এবং শুনে। [১৮:৫৪]
খাটি স্বর্ণ যেমন পরীক্ষা ছাড়া গুণাগুন বিচার হয়না তেমনি আল্লাহর পক্ষ্য থেকে প্রেরিত সত্য জ্ঞান অন্বেষণকারীকেও আল্লাহ পরীক্ষার মাধ্যমেই বাছাই করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালার এ পরীক্ষা দুইভাবে আমাদের সামনে আসতে পারেঃ
কাউকে আল্লাহ পরীক্ষা করতে পারেন সন্দেহের দোলাচলে আবার কাউকে এই দুনিয়ার মোহের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে পারেন।
আর যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করেন তারাও দুই ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। সেগুলো হচ্ছেঃ
১. আজেবাজে চিন্তা
মনের ভিতর জেগে উঠা অদ্ভুত সব চিন্তার মাঝে থাকতে পারে এমন কোন বিষয় যা মানুষের একাগ্রতাকে নষ্ট করে দেয়। যেমন এ বিষয়টি শুরুতে কেমন ছিল? এখন কেমন আছে? আদৌ সেই আগের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে কি না? ইত্যাদি নানা বিষয় মাথায় এসে ইবাদতের একাগ্রতাকে বিনষ্ট করে দেয়।
এ ধরণের সমস্যার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, নামাজে কিংবা এর বাইরে মনের ভিতর নানান চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে আল্লাহর কালাম সঠিকভাবে তেলাওয়াতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যে ব্যক্তি শুধুমাত্র তার ঠোট, জ্বিহবা, চোয়াল, ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ছাড়া আর কিছুই টের পায়না সে কি করে আল্লাহর এ রাজত্বের গোপন সৌন্দর্য জানবে?
২. অপর সমস্যাটি হচ্ছে কোর’আনের যথাযথ অর্থ অনুধাবন থেকে নিজেকে বিরত রাখা
ইবাদতে একনিষ্ঠ এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন যারা আল্লাহ প্রেরিত মানবতার পথ নির্দেশক কোর’আনুল কারীমের মর্মার্থ বুঝতে চান না কিংবা তা থেকে দূরে থাকেন। প্রকৃত কথা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন তার দুই ধরণের অর্থ বিদ্যমান। একটি হচ্ছে সাধারণ অর্থ যাকে আমরা মানব দেহের বহির্ভাগের সাথে তুলনা করতে পারি অপরটি হচ্ছে কালামুল্লাহর মর্মবাণী যাকে আমরা মাদের দেহের আভ্যন্তরীণ ভাগের সাথে তুলনা করতে পারি।
যেমন আল্লাহ তার বান্দাদের আদেশ করেছেন যে তারা যেন বিশ্বাস করে তাঁকে দর্শন সম্ভব। এখানে দেখারও দুইটি আলাদা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অর্থ রয়েছে।
যদি কেউ মনে করে যে আল্লাহকে দেখতে পাওয়া মানে হচ্ছে আমরা পৃথিবীতে সাধারণ মানুষজনকে যেভাবে দেখি সেভাবে দেখতে পাওয়া তাহলে আল্লাহর বাণী “তোমরা আমাকে দেখতে পাবেনা....” (৭:১৪৩) আয়াতটির অর্থ তারা কি বলবেন?
একই ভাবে যদি আমরা আমাদের সাধারণ চিন্তার আলোকেই কোর’আনের গোপন সৌন্দর্য্য খুঁজি তবে আমাদের এ জাগতিক চক্ষু দিয়ে আল্লাহ দেখার মত অসম্ভব কাজ কি করে সম্ভব করব? অথবা যে ব্যক্তি এমন চিন্তা চেতনায় মগ্ন সে কিভাবে দুইটি বিপরীত ধর্মী আয়াত যা আল্লাহ কোর’আনে বলেছেনঃ
“কোন চক্ষুই তাঁকে দেখতে পাবে না।” (৬:১১০) আবার বলেছেনঃ
“সে দিন, অনেকের মুখ হবে উজ্জল এবং তারা তাদের রবের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।” (৭৫:২২-২৩)
এ সমস্যার সমাধান তারা সাধারণ চিন্তায় মগ্ন হয়ে কি করে খুঁজে পাবেন?
৫. কোর’আনের আলোয় আলোকিত হোন
কোর’আনের আসল স্বাদ পেতে হলে অবশ্যই কোর’আন আরও ভাল করে বোঝার ক্ষেত্রে নিজেদের কোন গন্ডিতে আবদ্ধ করবেন না, প্রতিটি আয়াত পড়ার সময় আয়াতের অর্থ ও এর মাহাত্ম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। এভাবে আপনি যতটুকু অধ্যয়ন করবেন ততটুকুই আপনার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে এবং আপনিও কোর’আনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারবেন।
তাই, কোর’আন পাঠের ক্ষেত্রে যখন আল্লাহ ক্ষমার কথা বলেছেন, তখন আপনি আনন্দিত হোন; যেখানে আল্লাহ কঠিন আজাবের হুশিয়ারি দিয়েছেন, সেখানে ভয়ে কম্পিত হোন; যেখানে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, মাথা নিচু করে সে বড়ত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন যেন আপনি আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের সামনে কিছুই না; যেখানে আল্লাহ কাফেরদের কথা বলেছেন, এবং নিজের সম্মানকে আপনার সন্তান ও পরিবারের উপর প্রাধান্য দিতে বলেছেন, কণ্ঠস্বর নিচু করুন ও আল্লাহর কাছে নিজের অযোগ্যতার কথা স্মরণ করে লজ্জায় মাথা নত করুন।
এভাবে যদি আপনি কোর’আন পাঠের সময় অনুভুতিগুলো নিজ অঙ্গেও সঞ্চালন করতে পারেন যেমন সুসংবাদে নিজ জ্বিহবা ও কন্ঠে সে সুখ অনুভব করছেন, আযাব ও ভীতির সংবাদে কন্ঠে আকুতি ঝড়ে পড়ছে, চোখ অশ্রুসিক্ত এবং ভয়ে বিহ্বল হয়ে শরীরে ঘাম ছুটেছে। এমন অবস্থা যখন আপনাকে ছেয়ে যাবে তখন কোর’আনে বরকত আপনার উপর অবিরত ধারায় বর্ষিত হতে থাকবে ।
লিখাটি ইমাম আবু হামিদ আল গাজ্জালির ‘কিতাবুর আরবা ইন ফি উসুল আদ-দ্বীন’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।
সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: