শহীদ তিতুমীর: স্বাধীনতাকামী এক মহান সংগ্রামী


আবরার শেখ
Published: 2018-11-19 14:52:09 BdST | Updated: 2024-05-14 21:40:22 BdST

Photo Credit: afsarnizam.blogspot

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন, পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার স্বাধীনতা হরন করে নেয় এর মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের দুইশত বছরের শাসন এবং শোষনের সূচনা ঘটে

বাংলার স্বাধীনতা হরন হলেও বাংলার সাধারণ মানুষ কখনোই তাদের উপর আরোপিত অধীনতাকে স্বীকার করে নেয়নি বরং যখনই তারা সুযোগ পেয়েছে, তখনই তারা নিজেদের গলা থেকে অধীনতার শিকল ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে ফকির বিদ্রোহ থেকে শুরু করে বারাসত বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ প্রভৃতি বিভিন্ন সুযোগে বাংলার মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল এসকল আন্দোলনের মধ্যে শহীদ তিতুমী বারাসত বিদ্রোহ ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। 

তিতুমীরের প্রকৃত নাম সাইয়েদ মীর নিসার আলী ছোট বেলায় একবার কঠিন অসুস্থতায় তার আগ্রহের সাথে তেতো ঔষধ খাওয়া থেকেই তার নাম তিতুমীর রাখা হয় বলে কথিত আছে ঈসায়ী ১৭৮২ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর (মতান্তরে হায়দারপুর) গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন ছোট থেকেই জ্ঞানচর্চার প্রতি তিনি ছিলেন প্রচন্ড আগ্রহী কুরআন হেফজ এবং আরবী ও ফারসী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি তিনি ইসলামী ধর্মশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, দর্শন, তাসাউফ প্রভৃতি বিষয়ের উপর জ্ঞানারোহন করেন জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি তিনি শরীরচর্চায়ও ছিলেন মনোযোগী তরুণ বয়সেই তিনি একজন দক্ষ কুস্তিগীর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। 

১৮২২ সালে তিনি মক্কায় হজ্জ্ব করার জন্য যান সেখানে তার সাথে উপমহাদেশের বিখ্যাত মুজাদ্দিদ এবং বিপ্লবী নেতা সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর সাক্ষাত হয় সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর সংস্পর্শে তিনি ইসলামের সংস্কার আন্দোলন এবং ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য অনুপ্রাণিত হন

১৮২৭ সালে দেশে ফিরে আসার পর তিনি সংস্কার আন্দোলনের কার্যক্রম শুরু করেন প্রথমেই তিনি মুসলমানদের কুসংস্কার মুক্ত করে ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় দীক্ষিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে তার আন্দোলন শুরু করা স্বত্ত্বেও অচিরেই তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হন

তিতুমীরের সংস্কার আন্দোলনে ভীত হয়ে স্থানীয় জমিদাররা তিতুমীরের আন্দোলনে বিভিন্ন প্রকার বাধা প্রদান করা শুরু করে দাড়ি রাখার জন্য কর আরোপ, মসজিদ নির্মানের জন্য কর ইত্যাদি বিভিন্নভাবে তারা তিতুমীরের আন্দোলনের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে

তিতুমীর এধরনের হয়রানী বন্ধের জন্য প্রথমে সরাসরি জমিদারদের সাথেই যোগাযোগের চেষ্টা করেন কিন্তু তার প্রতিনিধিকে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হত্যা করলে তিনি আইনের আশ্রয় গ্রহন করেন তিনি কলকাতার আদালতে বিচার প্রার্থণার জন্য গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিতুমীরের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ব্যর্থতায় জমিদাররা অধিক উৎসাহিত হয়ে তার অনুসারী এবং সাধারন লোকদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করে তিতুমীর এই অত্যাচারকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এর জন্য তার অনুসারীদের সংগঠিত করেন

১৮৩১ সালের অক্টোবরে চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসত মহকুমার নারকলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমীর বাঁশ দিয়ে এক কেল্লা নির্মান করেন দ্বিতল এই কেল্লাকে কেন্দ্র করে তিনি তার প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা করেন বাঁশ দিয়ে নির্মিত বলে এটি ইতিহাসে বাঁশের কেল্লা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তার অনুসারীদের তিনি একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপ দেন এবং স্থানীয় জমিদার-নীলকরদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন

তিতুমীরের সাথে সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে জমিদার-নীলকররা ব্রিটিশ সরকারের দ্বারস্থ হয় তারা ব্রিটিশ শাসনের জন্য তিতুমীরকে এক ভয়াবহ হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে তাকে দমনের জন্য সামরিক পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করে

ইংরেজ সরকার তাতে সাড়া দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম স্কটের নেতৃত্বে দুইটি কামান সহ একটি সশস্ত্র বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করে ১৮৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর তারা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ঘেরাও করে

তিতুমীর তার সঙ্গী সাথী সহ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কিন্তু আধুনিক কামান ও বন্দুকধারী সশস্ত্র ইংরেজ সেনাদের সাথে লাঠি ও বল্লমধারী তিতুমীরের অনুসারীরা বেশীক্ষণ লড়াই চালাতে সক্ষম হননি ইংরেজদের কামানের গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় এবং তিতুমীর তার অসংখ্য সাথী সহ শাহাদাত বরন করেন তিতুমীরের মোট ৩৫০ জন অনুসারীকে ইংরেজরা বন্দী করে পরবর্তীতে বিচারে এদের মধ্যে তিতুমীরের প্রধান সহকারী এবং তার বাহিনীর প্রধান গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদন্ড এবং অপর ১৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়

তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমাপ্তির পর ইংরেজরা তিতুমীর সহ সকল শহীদদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে ফেলে, যাতে করে কেউ তাদের শহীদ হিসেবে সম্মান করতে না পারে ইংরেজরা যদিও তার মৃতদেহকে বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু তার স্মৃতিকে বিনষ্ট করতে পারেনি তাই শাহাদাতের ১৮৭ বছর পরেও তিতুমীর আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন

 

তথ্যসূত্র:

১. বাংলাপিডিয়া

২. উইকিপিডিয়া

 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


অখন্ড ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত যেসব মুসলমানরা এসেছিলেন, তাদের দুই শ্রেণী...

বাংলাদেশ | 2017-09-16 15:11:25

বাংলাকে বলা হতো ‘জান্নাতুল হিন্দ’ । তথা ভারতের বেহেশত। কেন বলা হতো? আস...

বাংলাদেশ | 2018-06-23 04:19:56

বাংলার মুসলমানদের পুনঃজাগরণে ও সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মে সৈয়দ আমীর আলী (১৮...

বাংলাদেশ | 2018-08-04 23:48:51

বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সুলতানদের দ্বারা অ...

বাংলাদেশ | 2017-09-16 19:02:46

ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও স...

বাংলাদেশ | 2017-12-19 11:52:45

মহান প্রভুর অশেষ রহমত এবং লাখো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব মানচি...

বাংলাদেশ | 2018-03-26 23:54:02

২০১৮ সালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে ১ দশমি...

বাংলাদেশ | 2018-07-21 04:34:59

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন, পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌ...

বাংলাদেশ | 2018-11-19 14:52:09