সোশ্যাল মিডিয়া যেভাবে আমাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাকে প্রভাবিত করে


মনিক হাসান; ভাবানুবাদঃ হুমায়রা হুসাইন
Published: 2022-06-13 21:41:20 BdST | Updated: 2024-05-14 23:53:15 BdST



সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়েছে। এটি আমাদের দৈনন্দিন ও ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় চিন্তাচেতনা ও আচার অনুষ্ঠান গুলোকে সবার সাথে শেয়ার করার এমন একটি সহজ মাধ্যম যার নিয়ন্ত্রন ও নির্ভর করে পুরোপুরি যা আমাদের ওপরই। মাঝে মাঝে নিজেকে এখানে খুব বেশী জড়িয়ে ফেলা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণাকেও প্রভাবিত করে ফেলে। আমাদের উপলব্ধি, আমাদের বাস্তবতা সম্পর্কে এমন ধরনের চিন্তা ও বিশ্বাসের তৈরী হয়ে যায় এখানের প্রতিক্রিয়া থেকে যার সাথে হয়ত আমাদের সত্যিকার বাস্তবতার মিল নাও থাকতে পারে। এই দ্বৈত ব্যক্তিত্ব আর অমিল একটি মানুষকে এতটাই প্রভাবিত করে ফেলতে সক্ষম যে নিজের স্বকীয়তা হারবার আশংকা থেকে যায়।
যখন আমরা এই অনলাইনে যোগাযোগ বজায় রেখে একজন মানুষের সাথে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলি তখন সেই ব্যক্তির সাথে সামাজিক, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত যাবতীয় কার্যকলাপের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখি ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। এভাবে এক সময় মনের অজান্তেই নিজেদের সাথে তুলনা করতে শুরু করি, যার দ্বারা আমাদের আত্মসম্মানবোধ , আমাদের ভিন্ন জীবনাচরন, বিশ্বাস ও কার্যক্রম সবকিছুকে প্রভাবিত করতে থাকে । এই আত্ম-সম্মান হলো একজন ব্যক্তির নিজস্ব মূল্যের মূল্যায়ন যা কখনই অন্যের জীবনের আদলে হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। সোশাল নেটওয়ার্কের কার্যক্রম আর প্রতিক্রিয়া দ্বারা আমরা নিজেদের মান কে যাচাই করে ফেলি। করি, একজন শিক্ষক যেমন A বা D গ্রেড দিয়ে থাকেন।
অনেক সময় দেখা যায় হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলনামূলক বেশী স্বাচ্ছন্দ্যে সক্রিয় থাকছে। পাশাপাশি এমন সব পরস্থিতি থেকেও সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে যা তার বাস্তব ও ব্যক্তিগত জীবনের ইতিবাচক আবেগ ও যোগাযোগ গুলোকে বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। এখানেই আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মান বোধের ঘাটতিটা তৈরী হয়, যা নিজেদের প্রতি আমাদের মনোভাবকে প্রভাবিত করে। আমরা আত্মসম্মানের সাথে একটি ভারসাম্য চাই, খুব বেশি নয় এবং খুব কম নয়। সুস্থ আত্মসম্মানবোধ ব্যক্তিত্বের জন্য প্রয়োজন, এটি অহংকার নয়। মুসলমান হিসাবে, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের মূল্য একটি উচ্চ মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হয়, তা হোলো ধার্মিকতা এবং বিশ্বাস। আল্লাহ বলেছেনঃ
“আর সেদিন [কর্মের] ওজন হবে সত্য। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে” (কুরআন ৭:৮)

 

সামাজিক তুলনা স্ব-সম্মানকে যেভাবে প্রভাবিত করে


আমরা প্রায়শই নিজেদের সাথে অন্যকে তুলনা করি। এই তুলনা ততক্ষন ভালো য্তক্ষন তা নিজের ব্যক্তিত্ব কে উন্নত করতে সাহায্য করে। কিন্তু এই তুলনা যদি অন্য কোন ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রম এর প্রতিক্রিয়া হয় তবে তা নিজদের জন্য ক্ষতিকর। কারন এখানে মানুষ ঠিক যতটুকু দেখাতে চায়, তাই দেখায়। যেমনঃ ভ্রমণ, দামি গাড়ি কেনা , কাবার সাথে সেলফি তোলা ইত্যাদি। এই তুলনা গুলো গঠনমুলক নয়, আমরা কারও জীবনের স্ব-নিয়ন্ত্রিত হাইলাইট রিল বা বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তারা তাদের ভুল গুলো কে বা অপ্রাপ্তিগুলোকে এখানে অপ্রকাশিত রাখে কৌশল অবলম্বন করেই , তাই আদতে বাস্তব জীবনে তাদের সাথে কি ঘটছে তা আমাদের জানার বাহিরেই থেকে যায়।

 

আত্মসচেতনতা

নিজেদের সম্পর্কে সৎ বিশ্লেষণ আমাদের চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, দুর্বলতা, দক্ষতা সম্পর্কে আমাদের সঠিক পরিমিতিবোধ দান করে । নিজের আত্মিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য আমাদের অবশ্যই সঠিকভাবে আত্ম-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হতে হবে। হীনমন্যতা বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা প্রদর্শনেচ্ছার মতো সংকীর্ণ আচরন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সামঞ্জস্যপূর্ন আত্মসচেতনতা থাকা অনিবার্য।যেতে করে অনলাইনের কোন রকম কার্যকলাপ আমাদের আত্মসম্মান বা মন মানসিকতায় কোন বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবেনা অথবা নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করার মত পরিস্থিতি তৈরী হবেনা।

ব্যক্তিত্বের ভারসাম্যহীনতা কিভাবে আমাদের ক্ষতি করতে পারেঃ
জাহির করা বা দেখানোর প্রবনতা যাদের মাঝে থাকে তারা ২ টি কারনে নিজেদের আত্মসম্মান বোধ ধরে রাখতে অক্ষম হয়ে থাকেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অসন্তোষ এবং সামাজিক মাধ্যম ও বাস্তব জীবনের সাথে অমিল। এরকম ভাবে ধীরে ধীরে আত্মমর্যাদা হারিয়ে নিজেকে নিয়ে এমন হতাশায় ডুবে যেতে থাকে যে একসময় নিজের জীবনের নিয়ামত গুলোকেও ধরে রাখতে পারেন না বা চিনতে পারেন না। এরকম অকৃতজ্ঞতার ও সাথে নিম্ন আত্ম-সম্মানবোধের কারনে একটা সময় জীবন কে ব্যর্থ মনে হতে থাকে।

 

কি উপায়ে আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা যায় ও ধরে রাখা যায়

নিজের প্রাপ্তি আর বাস্তবতা কে নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকা এমন একটি ইতিবাচক চর্চা যা আমাদের মানসিকতা কে সতেজ রাখে, আমাদের নিয়ামতগুলোর চিনতে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখায়। কঠিন অবস্থায় ও নিজেদের ভারসাম্য বজায় রেখে শিক্ষা নিতে শেখায়। আমাদের নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হতে কুরআন ও হাদীসে দেখানো হয়েছে।
"'যদি তুমি কৃতজ্ঞ হও, আমি অবশ্যই তোমাকে বৃদ্ধি করব" [কোরান 14:7]
সোশ্যাল মিডিয়ার কার্যক্রমের ভিত্তিতে সফলতা ও সমৃদ্ধিতে আমাদের উপরে যারা আছে তাদের সাথে নিজদের তুলনা না করে আমাদের নিজেদের আশীর্বাদের প্রতি সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে উন্নত আচরন সেগুলোই যেগুলো ইসলাম স্বীকৃত মৌলিক মানবীয় আচরন যেমন - কৃতজ্ঞতা, করুণা , শোকরগুজার হওয়া।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেনঃ
"তোমার নিচে যারা আছে তাদের দিকে তাকাও এবং যারা তোমার ওপরে আছে তাদের দিকে তাকাও না, কেননা আল্লাহর নেয়ামতকে কম মনে করাটাই বেশি উপযুক্ত।" [সুনানে ইবনে মাজাহ]

 

দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন নাকি বাস্তবতা পরিবর্তন – কোনটি প্রয়োজন?

দৃষ্টি পরিষ্কার রাখতে যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন চশমা পরতে হয় ঠিক তেমনি ভাবে ওপর একজনের চশমা দিয়েও কিন্তু পরিষ্কার দেখা যায়না। তাই যার যার অন্তঃদৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং গভীরতা সেই ব্যক্তির মাপকাঠিতেই হবে। তাই অন্য কারোর চশমা দিয়ে দেখা তথা অন্য কারো জীবনের স্থানে নিজেকে বসিয়ে ভাবতে থাকলে সামনের সবকিছু ঝাপসাই থেকে যাবে এবং হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।
যদি আমরা সচেতনভাবে বোঝার চেষ্টা করি যে আমরা কোন জোড়া চশমা পরে আছি এবং তা দিয়ে আমরা আমাদের পরিবেশকে কীভাবে দেখি এবং এর সাথে কিভাবে যোগাযোগ করি বা তা পরিবর্তন করছি বা নিজেকে প্রভাবিত করছি তাহলে আমাদের স্বকীয়তা আর বাস্তবতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্যক্তিগত জীবন উভয় ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে। আল্লাহ বলেছেনঃ
"নিশ্চয়ই, আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের মধ্যে যা আছে তা পরিবর্তন না করে" [কুরআন 13:11]
এই চিন্তাধারার পরিবর্তন এর ফলে যদি কারো ভ্রমন করার ছবি আমাদের সামনে আসে তবে আমরা নিজদের সাথে তুলনা করে হতাশা বা নেতিবাচক চিন্তা ও মন্তব্যের বদলে মনে করবো যে এটি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) পক্ষ থেকেই আসে যখন কাউকে ভ্রমণ করার ক্ষমতা বা নতুন বিয়ে করার মতো আশীর্বাদ দেওয়া হয়। পাশাপাশি আমরা তাদের অব্যাহত সাফল্যের জন্য দুআ করতে পারি এবং আমাদের যে আশীর্বাদ রয়েছে তার জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারি। আল্লাহ বলেছেনঃ
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার (মুসলিম) ভাইয়ের জন্য তা চায় যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। [আল-বুখারী]

 

ক্লোজিং থট

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে পারে উপকারী এবং ইতিবাচক সেই সাথে ইসলামী আলোচনার উৎস। যদি আমরা এটিকে সংযম, নৈতিকভাবে ব্যবহার করি এবং যোগাযোগ করার সময় একটি ইতিবাচক বিশ্বাস-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখি। স্বাস্থ্যকর আত্মসম্মান এবং কৃতজ্ঞতা একটি ভাল মানের জীবন এবং সুখী স্বভাবের অংশ।

 

উৎস

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


বিবিধ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


মক্কার পবিত্র কাবার ঘরের সংলগ্ন উত্তরের কিছু অংশ অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্ত...

বিবিধ | 2018-08-14 23:29:33

আমরা কোনো কঠিন মূহুর্ত বা বিপদের সম্মুখীন হলে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ি। আল...

বিবিধ | 2021-06-24 04:03:23

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2021-09-05 19:36:28

গত ১৪ই জুন ক্রীড়াজগতের অন্যতম বৃহত্তম আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের আনুষ্ঠানিক...

বিবিধ | 2018-06-22 22:32:19

রাত ১২টা বা ১টা পর্যন্ত জেগে থাকাটা ছিল আমার অন্যতম একটি বদভ্যাস। ছোট...

বিবিধ | 2018-03-26 09:49:08

ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, উভয় ধর্মেই পৃথিবীর সমাপ্তির পর্বের মিথ্যা খোদা দা...

বিবিধ | 2019-02-17 23:09:17

ইবনে খালদুন আসাবিয়াতত্ত্ব বা গোষ্ঠী সংহতির উপর রাষ্ট্র দর্শনের ভিত্তিক...

বিবিধ | 2019-03-29 23:50:18

১. ধৈর্যশীল যিনি সব পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণে সক্ষম, কখনোই চিৎকার চেঁচাম...

বিবিধ | 2021-09-04 20:19:56