মুহাম্মদ সা. ও হযরত ফাতেমা (রা.) এর সম্পর্কের আলোকেআদর্শ বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত


থেরেসা করবিন; অনুবাদ: সাদিয়া সামিরা
Published: 2018-01-29 10:11:48 BdST | Updated: 2024-05-15 05:31:32 BdST

Photo Credit:The True Knowledge

আধুনিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাবা-মেয়ের সম্পর্কের একটি বিশেষ প্রভাব দু পক্ষের জীবনের উপরই রয়েছে। কন্যারা তাদের বাবা থেকেই শিখে যে কি ধরণের মানুষের সাথে তাদের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত। আর বাবারা তাদের কন্যাদের থেকে অমায়িক, ধৈর্যশীল এবং স্নেহময় হতে শেখে।

হযরত ফাতেমা রা. ও হযরত মুহাম্মদ সা. এর মতো বাবা-মেয়ের সম্পর্কের  মহৎ উদাহরণ আর নেই। তারা কীভাবে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতেন তা অধ্যয়ন করে আমরা আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক সেই  অনুযায়ী গড়ে তুলতে পারি ও এর উত্তম ফল ভোগ করতে পারি।  

 

বাবার প্রতি হযরত ফাতেমা রা. এর অনুরাগ

ফাতেমা রা. এর জন্ম হয় তখন, যখন রাসুল সা.  মক্কার আশেপাশের বিভিন্ন পর্বতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। কিন্তু এই দূরত্ব তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের নমুনাকে নির্দেশ করে না। ফাতেমা রা.  এর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তিনি জানতে পারেন যে তাঁর বাবা আল্লাহ্‌র বার্তাবাহক হিসেবে  নিযুক্ত হয়েছেন এবং হযরত ফাতেমা এই সুসংবাদপ্রাপ্ত প্রথম সৌভাগ্যবানদের একজন।   

যখন ফাতেমার বয়স ১০ বছরের কাছাকাছি, তখন একদিন রাসুল সা. মসজিদ-উল-হারাম এ নামাজ পড়া অবস্থায় পৌত্তলিক কুরাইশদের একটি দল রাসুল সা. এর নিকট পৌঁছে। ভয় দেখিয়ে দলটি রাসুলের কাছে যায়। এর মধ্যে দলটির মূল হোতা আবু জাহেল বলে ওঠেঃ

‘তোমাদের মধ্যে কে মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি এনে মুহাম্মাদের উপর ছুঁড়তে পারবে?’ উকবাহ ইবনে আবু মুয়াইত নামে, এদের মধ্যে জঘন্য ও দুশ্চরিত্রের একজন হুড়োহুড়ি করে স্বেচ্ছায় ছুটে যায় ও ফিরে আসে নোংরা আবর্জনা নিয়ে আর তা সেজদারত রাসুলের কাঁধে ছুড়ে দেয়, আল্লাহ্‌ তাঁর উপর রহমত ও শান্তি বর্ষিত করুক।  আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, রাসুল সা. এর একজন সাথী, তিনিও সেখানে ছিলেন কিন্তু কিছু করার বা বলার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিলনা।”  

ফাতেমা এই অবক্ষয়ের সাক্ষী ছিলেন যখন তাঁর বাবা মহান আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে নামাজ আদায় করছিলেন। কিন্তু এই কোমল বয়সেও তিনি এটাকে তাঁর লজ্জার বা  ভয়ের কারণ হতে দেন নি। বাবার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান দেখিয়ে, ফাতেমা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তাঁর নামাজরত পিতার শরীর থেকে আবর্জনা ফেলে দিয়ে রাসুল এবং কাফিরদের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। পৌত্তলিক কুরাইশগণ তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে যারপরনাই অবাক হয় এবং আর কিছুই বলতে পারেননি।   

ফাতেমা তাঁর বাবাকে বার বার কুরাইশদের থেকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতেন, কেননা রাসুল নানা ভাবে মক্কার   কুরাইশদের দ্বারা অপমান এবং আঘাতের শিকার হতেন। রাসূলের প্রতি ফাতেমার এমন আচরণ দেখে তিনি কন্যা ফাতেমার জন্য ভালোবাসা আরো প্রবল করেন। আমাদের মধ্যে কতজন প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান তাদের পিতার জন্য  এরকম সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে? আমরা হযরত ফাতেমা রা. এর উদাহরণ থেকেই শিখতে পারি যে একজন আদর্শবান ও অনুগত সন্তান বলতে কি বুঝায়।  আমাদের পিতামাতার কাছে অসাধারণ হওয়ার জন্য কোন বিশেষ অবস্থার প্রয়োজন নেই।  শুধু মাত্র তাদের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন প্রয়োজন।

 

নবীজির পিতাসুলভ ভালোবাসা ও স্নেহ

“এটি একটি ভুল ধারণা যে বাবা হলেন পরিবারের নিছক একজন উপার্জনকারী, সংসারে সহায়তাকারী, যেন পরিবারে প্রাথমিকভাবে তার ভূমিকা প্রথমে অর্থ প্রদান করা এবং পরে শিক্ষাদান করা। আর সর্বোপরি, এটা কি শুধুই মায়ের কাজ সন্তান লালন-পালন করা? এটা কি শুধুই মায়ের দায়িত্ব তার মেয়েকে শিখানো যে একজন মেয়ে বা নারী হওয়ার মানে কি?” লিখেছেন জয়নব (নাম অপ্রকাশিত)

হযরত খাদিজা রা. এর সাথে রাসুলের ৫ম সন্তানের সম্পর্কের দিকে এক নজর তাকালেই তা বুঝতে পারা যায়। এটি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। বাবাদের তাদের কন্যার লালন-পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

রাসুল সা. এর অন্তরে হযরত ফাতেমার জন্য এক বিশেষ স্থান ছিল। হযরত ফাতেমা, যাকে নিয়ে হযরত আয়শা রা. বলেন,

“ যখন রাসুল তাকে (ফাতেমা) আসতে দেখতেন, তিনি তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতেন, দাঁড়িয়ে তাকে চুমু খেয়ে তাঁর হাত ধরে নিয়ে আসতেন এবং তিনি যেই স্থানে বসে ছিলেন তাকে সেখানে বসাতেন।''

নবীজি তাঁর কন্যাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন, নবীজি ফাতেমাকে শিখিয়েছেন, এবং নবীজির আশেপাশের সকল লোককে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এমনকি আমাদের আজও শিক্ষা দিচ্ছেন যে, কন্যার প্রতি উত্তম আচরণ আসলে কেমন হয়।

কতজন বাবা তাদের কন্যাদের প্রতি এমন মনোযোগ ও মর্যাদা প্রদর্শন করে? কন্যাদের প্রতি বাবার দূরত্ব ও বৈরি মনোভাব প্রদর্শন আজ সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ ইসলামিক সংস্কৃতিতে বা ইসলামিক পরিবারগুলোতেও ে প্রভাব দেখা যায় না।    

রাসুল সা. একদা বলেনঃ

“যে ফাতেমাকে খুশি করলো সে যেন আল্লাহকেই খুশি করলো, আর যে ফাতেমাকে রাগান্বিত করলো সে যেন আল্লাহকেই রাগান্বিত করলো। ফাতেমা আমার একটি অংশ। যা তাকে খুশি করে তা আমাকেও খুশি করে আর যা তাকে রাগান্বিত করে তা আমাকেও রাগান্বিত করে।” (বুখারি এবং মুসলিম)

যেসব পিতারা যারা তাদের কন্যার সাথে একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করে ও বজায় রাখে তারাও দেখতে পাবে যে এটা তাদের ক্ষেত্রেও সত্য। যা তাদের কন্যদের কষ্ট দেয় ও রাগান্বিত করে তা তাদেরকেও কষ্ট দেয় ও রাগান্বিত করে। বাবা এবং মেয়ের মাঝের এই সম্পর্ক অখণ্ডনীয় আর এটা প্রাকৃতিক ভালোবাসা থেকেই লালিত হয়।

 

বাবা-মেয়ের সম্পর্ক অনেক ফলপ্রসূ একটি সম্পর্ক

তাদের মাঝে শুধু পারস্পরিক সম্মানই না, তারা একে অপরের প্রতি অনুগ্রহও প্রদর্শন করে। হযরত ফাতেমা ও রাসুল (সা)ও একে অপরের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। একদিন রাসুল হযরত ফাতেমাকে নিমন্ত্রণ করলেন।

যখন ফাতেমা আসলেন, রাসুল তাকে চুমু খেলেন এবং তাঁর কানে কানে কিছু বললেন। ফাতেমা কেঁদে দিলেন। অতঃপর আবার রাসুল তাঁর কানে ফিস ফিস করে কিছু বললেন এবং ফাতেমা হেসে দিলেন। হযরত আয়শা তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি একই সাথে হাসলে এবং কাঁদলে ফাতেমা? আল্লাহ্‌র রাসুল তোমায় কী বলেছেন?”  ফাতেমা উত্তর দিলেন, “ প্রথমে তিনি বলেছেন যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, তাই আমি কেঁদেছিলাম। তারপর তিনি বললেন, “ কেঁদো না, আর আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম যে আমার সাথে যোগদান করবে’। আর তাই আমি হেসেছি।”

ফাতেমা রা. কে তাঁর পিতার মৃত্যুর শোক  বেশিদিন বইতে হয়নি কেননা তাঁর পিতার পরবর্তী অনুসারী তিনিই হবেন। এমনকি তাঁর নিজের মৃত্যুর সংবাদ ও তাকে হাসিয়েছে কেননা এর মানে হলো তিনি খুব শীঘ্রই তাঁর পিতার কাছে পৌঁছবেন। আর এটাই হলো একজন কন্যার তার পিতার উপস্থিতিতে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যবোধের চিহ্ন, এবং একজন পিতার যিনি ভালো করেই জানেন যে, কি বলার মাধ্যমে তাঁর মেয়ের মাঝে আনন্দ ফিরিয়ে আনা যায়।   

এটা পিতা-কন্যার সম্পর্কের একটি অসাধারণ উদাহরণ। কিন্তু এটা ভাবা খুবই বোকামি যে এখনকার সময় এটা আমাদের নাগালের বাইরে। মেয়েরা হযরত ফাতেমার উদাহরণ থেকে বাবার প্রতি প্রচণ্ড আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন শিখতে পারে। আর বাবারা রাসুলের থেকে শিখতে পারেন তাদের কন্যাকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া, যা রাসুল হযরত ফাতেমার জন্য দেখাতেন। পিতা-কন্যার সম্পর্ক মূলত স্নেহপূর্ণ, সম্মান, মর্যাদা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের, এবং আমাদের নবীজি ও হযরত ফাতেমা (রা) এর জ্বলন্ত উদাহরণ।  

 

উৎস

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


পরিবার ও জীবন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত


বিয়ে নানাভাবে আমাদের জীবনে ভূমিকা রাখে। এমনকি এটা আমাদেরকে সুখী করে, প...

পরিবার ও জীবন | 2021-09-13 20:28:40

আসসালামু আলাইকুম,আমার ১৫ বছরের ভাই হস্তমৈথুন আসক্ত যা সে আরো আগে থেকেই...

পরিবার ও জীবন | 2017-09-15 00:22:34

আধুনিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাবা-মেয়ের সম্পর্কের একটি ব...

পরিবার ও জীবন | 2018-01-29 10:11:48

‘মা, আপনি কেন আমার ঘরে ঢোকার আগে দরজায় নক করেন না?’ এই প্রশ্নটি অনেক...

পরিবার ও জীবন | 2020-10-13 23:55:17

অনেক মুসলিম মনে করেন, যৌন আকর্ষণ অনুভব করাটাই পাপের কাজ।  আমার পিতা বল...

পরিবার ও জীবন | 2017-12-31 11:16:02

বিয়ে করতে গেলে তিনটি পর্ব বা তিনটি সময় অতিক্রম করতে হয়। এক – খিতবাহ ব...

পরিবার ও জীবন | 2017-11-25 21:48:23

আমাদের বেড়ে ওঠার পেছনে আমাদের বাবা ও মায়ের যথেষ্ট পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বী...

পরিবার ও জীবন | 2021-08-28 20:47:20

গর্ভের সন্তানের সাথে কথা বললে একেবারে শুরু থেকেই সন্তান ও মায়ের মাঝে এ...

পরিবার ও জীবন | 2017-12-14 10:21:19